হবিগঞ্জে চার শিশু হত্যায় অংশ নেয় ৬ জন
হবিগঞ্জের সুন্দ্রাটিকি গ্রামে চার শিশু হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে পঞ্চায়েতপ্রধান আবদুল আলী বাগালের ছেলে রুবেল মিয়া।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম-১ কৌশিক আহমেদ খোন্দকারের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে খুনের বর্ণনা দেয় রুবেল মিয়া। বিকেল ৫টা ১০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত জবানবন্দি দেয় সে।
রুবেল মিয়া স্থানীয় ফয়জাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলমান এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সালেহ আহমেদ নামের সুন্দ্রাটিকির এক বাসিন্দাকে আজ শনিবার সকালে আটক করেছে পুলিশ। বাহুবল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেন জানান, রুবেল মিয়ার জবানবন্দিতে এই ব্যক্তির নাম না থাকলেও সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে আটক করা হয়েছে। পরে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে কি না।
পুলিশ সুপারের ভাষ্য
গতকাল রুবেলের জবানবন্দি শেষ হওয়ার আধাঘণ্টা পর হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জয়দেব কুমার ভদ্র এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সুন্দ্রাটিকি গ্রামে বাগাল পঞ্চায়েত এবং তালুকদার পঞ্চায়েতের বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এক মাস আগে বাগাল ও তালুকদার পঞ্চায়েতের সীমানায় থাকা একটি বড়ই গাছ কাটা নিয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। পরে বিষয়টি সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করা হলেও সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক বাচ্চু মিয়া ও গ্রেপ্তার হওয়া আরজুকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এরপর থেকেই তারা পরিকল্পনা করে বাগাল পঞ্চায়েতের শিশুদের হত্যা করবে।
১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকেলে পূর্ব ভাদেশ্বর গ্রামে ফুটবল খেলা দেখতে যায় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র জাকারিয়া শুভ (৮), তার চাচাতো ভাই আবদাল মিয়ার ছেলে প্রথম শ্রেণির ছাত্র মনির মিয়া (৭), আরেক চাচাতো ভাই আবদুল আজিজের ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তাজেল মিয়া (১০) ও পাশ্ববর্তী বাড়ির আবদুল কাদিরের ছেলে সুন্দ্রাটিকি আনওয়ারুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসার নুরানী প্রথম শ্রেণির ছাত্র ইসমাইল মিয়া (১০)। তবে বৃষ্টির কারণে খেলা না হওয়ায় শিশুরা হেঁটে বাড়িতে ফিরে আসতে থাকে।
এ সময় ওত পেতে থাকা বাচ্চু মিয়া শিশুদের বাড়িতে দিয়ে আসার কথা বলে তার সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠতে বলে। বাচ্চু মিয়া তাদের পরিচিত হওয়ায় সরল বিশ্বাসে চার শিশু অটোরিকশায় উঠে। এ সময় তাদের চেতনানাশক দিয়ে অজ্ঞান করে বাচ্চু মিয়ার গ্যারেজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আরজু ও রুবেলসহ ছয়জন মিলে তাদের বুকের উপর বসে গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। চেতনা নাশকে নিস্তেজ হয়ে পড়া শিশুদের যে যেভাবে পেরেছে সেভাবে হত্যা করেছে বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছে রুবেল মিয়া।
হত্যার পর লাশগুলো বস্তায় ভরে গ্যারেজেই লুকিয়ে রাখা হয়। গভীর রাতে গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ইছারবিল খালের পাশে লাশগুলো বালিমাটিতে পুঁতে রাখা হয়। হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার ঘাতক দলের দুজনের নাম প্রকাশ করলেও তদন্তের স্বার্থে বাকি চার আসামির নাম প্রকাশ করেননি। এ ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, বেলাল মিয়া, শাহেদ, উস্তার ও বাচ্চু শিশুদের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।
পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র আরো জানান, ঘটনার আলামত উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে বাচ্চুর ব্যবহৃত সিএনজিচালিত অটোরিকশা, আরজুর বাড়ি থেকে কোদাল আর শাবল, রাস্তা থেকে কয়েকটি বস্তা এবং একটি রক্তমাখা পাঞ্জাবি উদ্ধার করা হয়েছে। রুবেলের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মোটিভ উন্মোচিত হয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, একজনের স্বীকারোক্তিই শেষ কথা নয়। সে কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে। আবার শত্রুতার কারণে কাউকে ফাঁসানোর চেষ্টাও করতে পারে। তাই তার স্বীকারোক্তিই শেষ কথা নয়। তদন্ত অব্যাহত থাকবে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে। প্রাথমিক তদন্তে ৬ জনের নাম এলেও রুবেল এবং আরজুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরজুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া আরজু, রুবেল ও বশিরের বিরুদ্ধে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। শুক্রবার ও শনিবার যেহেতু আদালত বন্ধ তাই রোববার রিমান্ড শুনানি হবে। গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ আসামিকে রিমান্ডে নিলেই প্রকৃত তথ্য পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে আশা করেন পুলিশ সুপার।
এসপি জয়দেব কুমার ভদ্র আরো বলেন, ১২ ফেব্রুয়ারি ঘটনার সময় সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আবদুল আহাদ চার শিশুকে বাচ্চু মিয়ার সিএনজি অটোরিকশায় দেখেছেন বললেও পরে অস্বীকার করেন। ফলে পুলিশ বিভ্রান্ত হয়েছে। নিহতদের পরিবারের অভিযোগ এবং কৌশল ব্যবহার করে ঘটনার মোটিভ উদ্ধার করা হয়। সুন্দ্রাটিকি গ্রামে ডিবি, ডিএসবিসহ ৫০ জন পুলিশ সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি করে সফল হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি মিডিয়ারও প্রচুর কষ্ট হয়েছে। একজনের জবানবন্দি পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয় না। তবে এই জবানবন্দি ঘটনার রহস্য উদঘাটনে ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার জন্য পুলিশের কোনো সদস্যের গাফিলতি রয়েছে কি না তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। যদি কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুক্রবার রাতেই তিন আসামিকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম, সহকারী পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমান মনিরসহ গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা।
এদিকে শুক্রবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বাহুবল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ অটোরিকশার মালিক বাচ্চু মিয়ার বাড়ির গোয়ালঘর থেকে সিএনজিটি (হবিগঞ্জ থ ১১-৩৬০৮) উদ্ধার করে। তবে এ সময় কাউকে আটক করা যায়নি।
সিলেটের ডিআইজির ভাষ্য
এদিকে সিলেটের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান বলেছেন, গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনই কমবেশি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। গতকাল বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত করতে। এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও এর পিছনে আরো কোনো গডফাদার জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সুন্দ্রাটিকি গ্রামের প্রায় ২০ লাখ টাকার তহবিল পঞ্চায়েত সর্দার সেলিম আহমেদের কাছে জমা ছিল। এর মধ্যে গ্রামবাসীর যৌথ শিরনি অনুষ্ঠানে ছয় লাখ টাকা খরচ করা হয়। বাকি ১৪ লাখ টাকা সেলিম আহমেদের কাছে রয়ে যায়। সেলিম আহমেদের কাছে গিয়ে আব্দুল আলী বাগাল টাকার হিসাব চান। এ নিয়ে সেলিম আহমেদের সঙ্গে আব্দুল আলীর কথা কাটাকাটি হয় এবং তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেলিম আহমেদকে শায়েস্তা করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ তালুকদার পঞ্চায়েতের ওয়াহিদ মিয়া ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অটোরিকশাচালক বাচ্চু মিয়াকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বাচ্চু মিয়া চার শিশুকে তাঁর অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যান।
এরপর ১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে বাচ্চু মিয়ার সহযোগিতায় ঠান্ডা মাথায় চার শিশুকে খুন করে ঘাতকরা। পরে সেলিম আহমেদের বালুর স্তূপে তাদের লাশ পুঁতে রাখে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বালু চাপা দেওয়ায় চারজনের মধ্যে একজনের হাত বালু থেকে বের হয়ে থাকে। খুন হওয়ার পাঁচদিন পর উল্লিখিত স্থান দিয়ে একই গ্রামের কাজল মিয়া অন্যদের সঙ্গে মাটি কাটার কাজে গেলে পঁচা গন্ধ পান। পরে তিনি এ গন্ধের রহস্য খুঁজতে গিয়ে হাত দেখতে পান। তারপর জোর চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন সেখানে ছুটে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধার করে।