চলে গেলেন অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিরাজুল হক
চার মাসেরও বেশি অচেতন থেকে চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক সভাপতি ও প্রখ্যাত গবেষক অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিরাজুল হক। আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে তিনি মারা যান।
অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিরাজুল হকের বড় ছেলে খোন্দকার জাহাঙ্গীর সিরাজ এনটিভি অনলাইনকে এ কথা জানান। মৃত্যুর সময় তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।
সিরাজুল হক গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১২’ লাভ করেন। এ ছাড়া ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি তাঁকে গবেষণা-সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য ‘সা’দত আলী আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার ২০১১’ প্রদান করে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাবিতে বেলা সাড়ে ১১টায়, পরে বাদ জোহর নগরীর বড় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় অংশগ্রহণ করতে সিরাজুল হক ঢাকায় আসেন। ২৭ ডিসেম্বর বিকেলে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ৮০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠান শেষে নিউ ইস্কাটনে ভায়রার বাসায় যান। সেখানেই তিনি রাত সাড়ে ৮টার দিকে স্ট্রোক করেন। পরের দিন মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে দুপুর আড়াইটার দিকে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়।
কিন্তু ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর জ্ঞান না ফেরায় গত ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। দীর্ঘদিন সেখানে চিকিৎসা চলার পর গত ৩১ মার্চ রামেক আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তারপর অচেতন অবস্থায়ই তিনি আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মৃত্যুবরণ করেন।
জাহাঙ্গীর সিরাজ এর আগে এনটিভি অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ধারদেনা করে এ পর্যন্ত চিকিৎসা চলছে। এখন সেই জায়গাগুলোও সংকুচিত হয়ে আসছে। সরকারের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি চিঠি দিয়েছি।’ তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনো সাহায্য পায়নি সিরাজুল হকের পরিবার।
ওই সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে জাহাঙ্গীর সিরাজ বলেছিলেন, ‘ভাবতে অবাক লাগে, বাংলা একাডেমি থেকে বাবাকে কেউ দেখতে আসেনি! প্রথমে তারা খোঁজখবর নিলেও এখন তাও নেয় না। অথচ যে বাংলা একাডেমির সঙ্গে বাবার এত সম্পর্ক! সাহিত্য চর্চা করতে গিয়ে ঠিকমতো ঘর-সংসারের দিকে ফিরে তাকাননি। অথচ তাঁর সার্কেলের কেউ কোনো খোঁজখবর পর্যন্ত রাখছে না।’
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৪১ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিরাজুল হক। ছাত্রজীবনে বরাবরই রেখে চলেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। ১৯৫৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে (ওই সময়ের একমাত্র শিক্ষা বোর্ড) প্রথম স্থান অধিকার করেন। এর ফলে কলম্বো পরিকল্পনার অধীনে বিনা খরচে ইংল্যান্ডে পড়াশোনার সুযোগ হয় তাঁর। কিন্তু সিরাজুল হক তা গ্রহণ করেননি। ১৯৬০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও বোর্ডে অবস্থান না থাকায় তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। এই বিভাগ থেকে তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। যা সে সময় খুব স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভাগ্যেই জুটত।
সিরাজুল হক কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৫ সালে মাইকেল মধুসূদন কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
লেখক হিসেবেও সিরাজুল হকের রয়েছে বেশ সুনাম। তিনি একে একে রচনা করেছেন ‘মো: এয়াকুব আলী চৌধুরী’ (জীবনীগ্রন্থ, ১৯৭০), ‘কাজী আব্দুল ওদুদ (জীবনীগ্রন্থ, ১৯৮৭), ‘ডাক্তার লুৎফর রহমান’ (জীবনীগ্রন্থ, ১৯৯৬), কাজী আব্দুল ওদুদ রচনাবলী (৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ খণ্ড), ‘দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ (সম্পাদনা গ্রন্থ, ১৯৭৫) এবং পত্রপত্রিকায় অসংখ্য প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
খোন্দকার সিরাজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি থেকে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ, সমাজ চিত্র ও সাহিত্যকর্ম’ নামে গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।