রাঙামাটি ছাত্রলীগ : দেড় মাসের অর্জন ১ ঘণ্টায় শেষ!
১৪ মার্চ ২০১৬। ওই দিন বিকেলে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের নূরুল হুদা কাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নয় শিক্ষার্থী বিদ্যালয় ছুটির পর নৌকায় করে কর্ণফুলী নদী পার হচ্ছিল। এ সময় নৌকা ডুবে গেলে ছাত্রলীগের তিন নেতা জীবনের মায়া ত্যাগ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ গত ১০ এপ্রিল ওই তিন নেতাকে সংবর্ধনা দেয় জেলা ছাত্রলীগ।
অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ ছিল। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা প্রশংসা করেন ছাত্রলীগের নেতাদের। এই সংক্রান্ত সংবাদগুলো সারা দেশের, এমনকি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হয়।
শুধু ওই সংবর্ধনাই নয়, একই সময় শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার শুরুর দিন রাঙামাটির বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষার্থীদের রুটিন কার্ড প্রদান, পাহাড়ের প্রধান উৎসব বৈসাবি উপলক্ষে বর্ণিল পোস্টারে সবাইকে শুভেচ্ছা জানানো, এক ছাত্রনেতার অসুস্থ বাবার চিকিৎসার্থে সংগঠনের তহবিল থেকে সহায়তা ও অর্থ সংগ্রহ করে দিয়ে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয় জেলা ছাত্রলীগ।
মূলত জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল জব্বার সুজন ও কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ বাপ্পা দেশের বাইরে থাকায় ছাত্রলীগের মূলধারার নেতাকর্মীরা জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাইফুল ইসলাম রাশেদ, সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চাকমা, পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি আলাউদ্দিন ও সম্পাদক অপু, সদর থানা ছাত্রলীগের নজরুল ও সুপায়ন এবং কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আহম্মেদ ইমতিয়াজ রিয়াদের নেতৃত্বে এসব কর্মসূচি পালন করেন। এঁরা সবাই সুজন-বাপ্পার বিরোধী বলয়ের নেতা হিসেবেই পরিচিত। সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা ছাত্রলীগের ইতিবাচক এসব কাজকে প্রাণান্ত সহযোগিতা করে আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করেন।
কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস। গত ২৭ এপ্রিল ভারত থেকে রাঙামাটিতে ফিরে আসেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুজন। তার কদিন আগেই ফেরেন কলেজ শাখার সভাপতি বাপ্পা। এঁরা দুজন ফিরে আসতেই দেড় মাসে তৈরি হওয়া ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি মুহূর্তে ঠুনকো কাচের মতোই ভেঙে পড়ে পুলিশের গাড়ি থেকে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায়।
২৮ এপ্রিল, রাত ৯টা ৪০ মিনিট
এর দুই দিন আগে ২৬ এপ্রিল শহরের কাঁঠালতলী থেকে চুরি হয় জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জমিরউদ্দীন ও যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহবুব এলাহীর মোটরসাইকেল। পরদিন থানায় পৃথক দুটি মামলা করেন তাঁরা। মামলার পর ২৮ এপ্রিল রাতে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের পাশের একটি গলি থেকে তিন সন্দেহভাজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ, নিজেদেরই একটি পিকআপ ভ্যানে। কিন্তু কাঁঠালতলী থেকে থানায় নেওয়ার পথে পুরাতন হাসপাতাল এলাকার মাতৃমঙ্গল শিশু হাসপাতালের সামনে একটি প্রাইভেটকার নিয়ে পুলিশের গাড়ির গতিরোধ করেন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুজন ও কলেজ সভাপতি বাপ্পা। তাঁরা পুলিশকে উদ্দেশ করে গালাগাল করতে থাকেন তাঁদের কথিত কর্মী আটকের অভিযোগ তুলে। এ সময় তাঁরা আরো বেশ কয়েকজন কর্মীকে ডেকে আনেন এবং পুলিশের পিকআপ থেকে আসামি নামিয়ে নিয়ে চলে যান। পুরো ঘটনায় নির্বাক হয়ে পড়ে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।
পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে বারবার অনুরোধ করার পরও আসামিদের ফিরিয়ে দেননি ছাত্রলীগের নেতারা। তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিকরা উপস্থিত হওয়ায় এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ছাত্রলীগের আসামি ছিনতাইয়ের ব্রেকিং নিউজ শুরু হয়। এতে বিপাকে পড়ে রাত আনুমানিক ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে আটক তিনজনের মধ্যে দুজনকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়া হয় এবং একজনকে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু পুলিশের পিকআপ আটকে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ততক্ষণে দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ খবর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, রেডিও, অনলাইন সংবাদপত্রের কারণে হাজার হাজার শেয়ার হতে থাকে এ সংক্রান্ত সংবাদ।
এই ঘটনায় অনেকেই বলতে থাকেন, মাত্র দেড় মাসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করে যে সুনাম অর্জন করেছিল রাঙামাটি ছাত্রলীগ, তা যেন সুজন আর বাপ্পার অদূরদর্শিতার কারণে এক ঘণ্টাতেই শেষ হয়ে গেল।
রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ চাকমা বলেন, ‘লড়াই-সংগ্রাম আর ঐতিহ্যের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য এই সংগঠনের ভাবমূর্তি আমরা নষ্ট হতে দিতে পারি না। আমরা শিগগিরই বসব এবং এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেব। আমরা এরই মধ্যে দলের সিনিয়র নেতাদের বিষয়গুলো জানিয়েছি। তাঁরাও এই বিষয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেবেন বলেই আশা করছি আমরা।’
রাঙামাটি জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি ও গত এক মাসে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সাইফুল আলম রাশেদ বলেন, ‘সভাপতির অনুপস্থিতিতে যে এক মাস আমি এবং প্রকাশ দায়িত্ব পালন করেছি, আমরা চেষ্টা করেছি ছাত্রলীগের সত্যিকার যে কাজ, সেসব কাজই করতে। তাই তো এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য রুটিন কার্ড প্রদান, তিন সাহসী ছাত্রলীগ নেতাকে সংবর্ধনা প্রদান এবং বাংলা নববর্ষ ও বৈসাবি উপলক্ষে শুভেচ্ছা পোস্টার করেছি। এসব কাজ সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু সভাপতি ভারত থেকে ফিরেই যে কাজ করল, তাতে আমাদের অর্জন সবই ভেস্তে গেল।’