মংলা পৌরসভায় সুপেয় পানির জন্য হাহাকার

মংলা পৌর এলাকায় সুপেয় পানির জন্য তীব্র হাহাকার শুরু হয়েছে। পৌর শহরে সুপেয় পানির প্রধান উৎস একমাত্র পানিশোধন ও সরবরাহ কেন্দ্রের পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে এখানে পানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
এ ছাড়া এখন পর্যন্ত এ এলাকায় তেমন কোনো বৃষ্টিও নেই। এ কারণে সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে।
পানির অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে লক্ষাধিক পৌরবাসী। সুপেয় পানির অভাবে অনেকে বাধ্য হয়ে চড়া দাম দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে পুকুরের লবণমিশ্রিত দূষিত পানি এনে তা পান করছেন এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করছেন। এতে করে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই, বিশেষ করে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কবে নাগাদ পানি সরবরাহ শুরু করা হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলছে না পৌর কর্তৃপক্ষ।
পৌরবাসীর অভিযোগ, পানি শোধনাগার কেন্দ্রে মাছ চাষ, সঠিক সময়ে নদী থেকে পানি উত্তোলন না করা, অযোগ্য লোক দিয়ে শোধনাগার চালানোসহ পৌর কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়মের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই) সূত্রে জানা যায়, লবণপানি অধ্যুষিত মংলাবাসীর সুপেয় পানির সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০০৫ সালে পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি উত্তোলন ও সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে পৌরসভার মাছমারা এলাকায় প্রায় ৮৪ একর জায়গায় পাঁচ লাখ লিটার ধারণক্ষমতার একটি উচ্চ জলাধার, ৪৬ কোটি লিটার ধারণক্ষমতার একটি পানিশোধন ও সরবরাহ কেন্দ্রের কাজ শুরু করা হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে হন্তান্তর করে। ছয় বছর ধরে পৌর কর্তৃপক্ষ পৌর এলাকার এক হাজার ৯০০ পরিবারকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক রেশনিং করে সকালে ও বিকেলে সুপেয় পানি সরবরাহ করে আসছিল। গত মাস থেকে পুকুরের পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর শুধু সকালে একবার সামান্য পানি সরবরাহ করা হতো। ১৬ মে থেকে এ সরবরাহ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
মংলা কেন্দ্রীয় বাজার মসজিদের খতিব মাওলানা তৈয়বুর রহমান বলেন, ‘১৭ মে পৌর কর্তৃপক্ষ মাইকযোগে জানিয়ে দেয়, পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় আপাতত আর পানি দেওয়া সম্ভব নয়।’
মংলা নাগরিক কমিটির সভাপতি শেখ নূর আলম বলেন, ‘পৌর এলাকার পানি সরবরাহ বন্ধ থাকায় চারদিকে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। চড়া দাম দিয়েও সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে পৌরবাসীকে নানা বেগ পেতে হচ্ছে। অথচ পৌর কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। এমনকি পানি সরবরাহ বন্ধ থাকলেও পৌরবাসীর কাছ থেকে ঠিকই পানির বিল আদায় করা হচ্ছে।’
পানি শোধনাগারের পাম্পচালক শাহীন বলেন, পুকুরের কিছু অংশের খননকাজ করায় পানি শুকিয়ে গেছে। তা ছাড়া নদীর পানি এখন অনেক লবণাক্ত। সেই পানি পুকুরে ওঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
এদিকে, পৌর এলাকায় পানিশোধন ও সরবরাহ কেন্দ্র চালু করার পর অধিকাংশ পৌরবাসী তাঁদের বাড়ির পুকুর বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলেছেন। এতে করে অধিকাংশ আবাসিক এলাকায় পুকুর না থাকায় খাবার ও ব্যবহারের জন্য পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া মংলা এলাকার টিউবওয়েলেও নোনাপানি ওঠে। এসব কারণে বাধ্য হয়ে লোকজন চড়া দাম দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে পুকুরের দূষিত নোনাপানি সংগ্রহ করে তা ব্যবহার ও পান করছে। নামেমাত্র যে কটি পুকুর রয়েছে, সেখানে নারী-পুরুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে এক কলস করে পানি সংগ্রহ করেন। কিন্তু সেসব পুকুরের পানিও শুকিয়ে এখন শেষের দিকে।
মংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কলসালট্যান্ট (শিশু) ডা. তরুণ কান্তি দাস জানান, প্রায় প্রতিদিনই শিশুসহ বিভিন্ন রোগী পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসে ভিড় জমাচ্ছেন।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী এস এম কায়েচ বলেন, ‘জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত নদীর মিষ্টিপানি সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুকুরে তোলা হয়। কিন্তু এবার পানি তোলার মৌসুমে পুকুরে পর্যাপ্ত পানি ওঠানো হয়নি। তাই এ সংকট দেখা দিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের এই শোধনাগার প্রকল্প যাঁরা দেখভাল করছেন, তাঁরা এ বিষয়ে কতটুকু যোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া পুকুরে মাছ চাষ করে সেই মাছ ধরতে গিয়েও কিছু পানি কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি আমি পৌর মেয়রকে লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
এস এম কায়েচ জানান, পৌরবাসীর প্রতিদিন পানির চাহিদা রয়েছে প্রায় এক কোটি লিটার। আর এর বিপরীতে পৌর কর্তৃপক্ষের সরবরাহের ক্ষমতা রয়েছে মাত্র ১০ লাখ লিটার। পৌর কর্তৃপক্ষ মাত্র কিছুসংখ্যক পরিবারকে পানি সরবরাহ করত, বাকিরা বিভিন্ন উপায়ে পানি সংগ্রহ করত। আর এখন তো সরবরাহ পুরোপুরিই বন্ধ। এখন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পানিশোধনের একটি গাড়িতে করে প্রতিদিন ৫০০ জনকে ১০ লিটার করে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম।
শেহালাবুনিয়া এলাকার গৃহবধূ প্রতিমা রানী, মানসী বিশ্বাস ও ফাতেমা বেগম বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের গাড়ি থেকে পানি আনতে যে লাইনে দাঁড়াতে হয়, তা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তাই এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।’
মংলা পৌরসভার মেয়র জুলফিকার আলী বলেন, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নতুন একটি পুকুর ও পুরোনো পুকুরের খননকাজ একসঙ্গে শুরু করেছে। তাই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া নদীর পানি তোলার পাইপেও তাঁরা কাজ করছেন। এ কারণে নদী থেকেও পানি তোলা যাচ্ছে না।