অবশেষে ভোটার হচ্ছেন বিলুপ্ত ছিটের বাসিন্দারা
দীর্ঘ জটিলতার পর অবশেষে ভোটার হতে যাচ্ছে বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দারা। সম্প্রতি ভোটার করতে নথি অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জুনের মাঝামাঝিতেই তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হচ্ছে।
আগামী দু-একদিনের মধ্যেই এসব এলাকার মাঠ কর্মকর্তাদের প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠানো হচ্ছে বলে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি ইসিতে ভোটার করার তাগদা দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সেখানকার ৩৭ হাজার ৫৩৫ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোছা. হাজেরা খাতুন স্বাক্ষরিত পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘গত ১১ এপ্রিল ১১১টি ছিটমহলবাসীর নামের তালিকাসহ গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ভোটার এলাকা পুনর্বিন্যাস শেষে ৩৭ হাজার ৫৩৫ জন বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীকে নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করবেন।’
ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীকে ভোটার করতে সম্প্রতি নথি অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এর আলোকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে দু-একদিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট এলাকার জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের চিঠি পাঠানো হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে এসব এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ করেছে। এর আলোকে ভোটার এলাকা পুনর্বিন্যাসও প্রায় শেষ করেছে কমিশন। ১১১টি সাবেক ছিটের মধ্যে পঞ্চগড়েরর বোদা উপজেলার বেহুলাডাঙ্গা ও কুড়িগ্রামের ডাকুরহাট ছিটমহলের ভোটার এলাকা পুনর্বিন্যাস বাকি রয়েছে। শিগগিরই এ কাজ শেষ করতে তাগদা দেওয়া হবে। কারণ জুনের মাঝামাঝিতে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হবে।
এর আগে গতবছর ৩১ জলাই বাংলাদেশ-ভারতের ছিটমহল বিনিময় হলেও নাগরিকত্ব পাননি এসব বঞ্চিত ছিটমহলবাসী। দীর্ঘ জটিলতা নিরসনের পর বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় পাচ্ছে না নাগরিকসেবা। শুধু নাগরিক সেবা থেকেই বঞ্চিত নয়, প্রথমবারের মতো বঞ্চিত হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকেও।
জানা যায়, বাংলাদেশে যুক্ত হওয়ার ১১ মাস পার হতে চললেও এখনো নাগরিকত্ব পায়নি বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। নাগরিকত্ব না পাওয়ার কারণে ভোটাধিকার, স্বাস্থ্যসেবা, ভূমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ অন্যান্য মৌলিক সেবা পাচ্ছে না। নাগরিকত্বের সনদ না থাকায় চাকরির জন্য আবেদন করতে পারছে না। পাচ্ছে না পাসপোর্টও। এ ছাড়া শিশুদের স্কুলে ভর্তি হতে হচ্ছে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির পর পরই ভারত সরকার ৫১টি ছিটমহলের ১৫ হাজার বাসিন্দাকে নাগরিকত্ব দিয়েছে। ছিটমহলের সমস্যা সমাধানে ৪১ বছর আগে ১৯৭৪ সালে দুই দেশের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করা হলেও গত বছর তা বাস্তবায়ন করা হয়।
ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহলের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। গত বছরের আগস্টে ভারত ও বাংলাদেশের নাগরিকসহ ছিটমহল বিনিময় হয়। কয়েকজন নাগরিক তাদের পছন্দমতো ভূখণ্ড পরিবর্তন করে। বাংলাদেশ কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও পঞ্চগড়ের ১১১টি ছিটমহল পায়, অন্যদিকে ভারত তাদের অংশের কোচবিহার ও পশ্চিমবঙ্গের ৫১টি ছিটমহল পায়।
গত বছর ৩১ জুলাই মধ্যরাত (আগস্টের প্রথম প্রহরে) থেকে ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হওয়ার পর শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা। বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল। গত বছরের ৬ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত পরিচালিত হেড কাউন্টিং অনুযায়ী সেখানকার জনসংখ্যা ৩৯ হাজার ৫৪৩ জন। এর মধ্যে কুড়িগ্রামে অন্তর্ভুক্ত ১২টি ছিটমহলে জনসংখ্যা আট হাজার ৭৫৭ জন। লালমনিরহাটে অন্তর্ভুক্ত ৫৯টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ১০ হাজার ৩৭৬ জন। নীলফামারীতে অন্তর্ভুক্ত চারটি ছিটমহলে জনসংখ্যা ৫৪৩ জন এবং পঞ্চগড়ে অন্তর্ভুক্ত ৩৬টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ১৯ হাজার ৮৬৭ জন। এই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো এখন বাংলাদেশের অংশ।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আবু হাফিজ বলেন, সরকার ছিটবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে। সীমানা বিন্যাসের কাজও শেষ হয়েছে। এখন শিগগিরই বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের ভোটার করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ইসির উপসচিব আব্দুল ওদুদ জানান, নানা জটিলতায় এত দিন ছিটমহলবাসীকে ভোটার করা সম্ভব হয়নি। শিগগিরই এসব এলাকায় ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করা হবে। এ জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন।
জানা যায়, ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকার শুরু থেকেই স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি চালাচালি করেও কোনো লাভ হয়নি। এর আগে ছিটমহলবাসীকে ছবিসহ ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে কয়েক দফা প্রস্তুতি নিয়েছিল ইসি।
২০০৮ থেকে শুরু করে ২০১২ এবং ২০১৪ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছিল। এরপর মন্ত্রণালয় দুটি জানায়, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময় সংক্রান্ত বিষয়টি বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় এবং চলমান বিষয়ের মধ্যে সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। বিরোধ নিষ্পত্তি হলে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হবে। তাই ছিটমহল নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভোটার তালিকা হালানাগাদে ছিটমহলবাসীকে আন্তর্ভুক্তিতে সম্মতি দেয়নি দুই মন্ত্রণালয়। এখন আর এসব বাধা নেই।