ঝিনাইদহে নিখোঁজ যুবকদের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে
ঢাকার গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলাকারী নিহত জঙ্গি নিব্রাস ইসলাম ঝিনাইদহ জেলা শহরের খোন্দকারপাড়ার একটি বাড়িতে চার মাস ভাড়া ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরো সাতজন। তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এ খবর প্রকাশিত হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঝিনাইদহের আরো অনেক যুবকই নিখোঁজ রয়েছেন। এনটিভি অনলাইনের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, এর বাইরে আরো অন্তত ৯ যুবক নিখোঁজ রয়েছেন। পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। এঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়ে গেছে বলেও পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে, পুলিশের পক্ষ থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
সম্প্রতি এক সপ্তাহের ব্যবধানে গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দুটি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। গুলশানের হামলায় দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যা করে হামলাকারীরা। এ ছাড়া হামলা ঠেকাতে গিয়ে প্রাণ দেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। অপরদিকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ সদস্য ও এক হিন্দু নারী নিহত হন।
গুলশানে উদ্ধার অভিযানের সময় ছয় জঙ্গি এবং শোলাকিয়ায় পুলিশের গুলিতে এক জঙ্গি নিহত হয়। পরে বেরিয়ে আসে, এসব জঙ্গি দীর্ঘদিন ধরেই নিখোঁজ ছিল, পরিবার থেকেও তারা ছিল বিচ্ছিন্ন। তাদের কেউ কেউ উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান এবং নামি-দামি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র ছিল।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ হলে তা অবশ্যই পুলিশকে জানাতে হবে। এরপর ছবিসহ ১০ যুবকের সন্ধান চেয়ে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যমে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেড় থেকে দুইশ যুবক নিখোঁজ রয়েছেন। এঁদের একটি বড় অংশই জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়েদার ‘শিকার হয়ে’ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থান করছেন।
এই অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেই নিখোঁজ আরো কিছু যুবকের তথ্য বেরিয়ে আসে। অনেক পরিবার স্বেচ্ছায় সংশ্লিষ্ট থানায় নিখোঁজ সদস্যের খোঁজ চেয়ে জিডিও করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ছেলের খোঁজ চেয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার চাপড়ি গ্রামের মো. শহিদুল ইসলামের স্ত্রী মোছা. সুন্দরী বেগম (৪৮)। জিডিতে তিনি বলেন, তাঁর ছেলে মো. হাসানুর রহমান (২২) গত ২০ জুলাই থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। হাসানুর ওই দিন প্রাইভেট পড়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। তারপর তিনি আর বাড়ি ফিরে আসেনি। সম্ভাব্য সব জায়গায় তল্লাশি চালিয়েও তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ঝিনাইদহের সদর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি-সদর সার্কেল) গোপীনাথ কাঞ্জিলাল হাসানুরের মায়ের জিডির সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি আরো জানান, এর আগে গত ৩ জুলাই ছেলে রাশেদুজ্জামান রোজকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকধারী লোকজন তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেন সদর উপজেলার সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা খয়বার রহমান। তিনি এ ব্যাপারে সদর থানায় একটি জিডি করেছেন।
জনতা ব্যাংক ঢাকার তালতলা শাখার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খয়বার রহমান ওই জিডিতে বলেন, তাঁর ছেলে রোজ কানাডায় পড়ালেখা করেছে এবং সেখানে চাকরিও করেছে। তবে পরে তিনি পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে আসেন এবং এখানে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন। এরই মধ্যে গত ২ জুলাই বেলা ১১টার দিকে রোজ সদর উপজেলার হলিধানী বাজারের নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসে ছিলেন। সেখান থেকেই তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সংশ্লিষ্ট থানায় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও রোজের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রোজের বাবা খয়বার রহমান বঙ্গবন্ধু পরিষদের ঝিনাইদহ জেলা কমিটির সাবেক সহসভাপতি এবং বর্তমান সদস্য। তাঁর মা রেজিয়া বেগম একজন জ্যেষ্ঠ সেবিকা। তিনি ঢাকায় একটি সরকারি হাসপাতালে কর্মরত।
এ ছাড়া সদর উপজেলার পাগলাকানাই ইউনিয়নের কোরাপাড়া বটতলা এলাকার হোসেন আলীর ছেলে জাহিদ ওরফে কোবরা জাহিদ, শৈলকুপা উপজেলার চরফুলহরি গ্রামের আমিরুল ইসলাম মণ্ডলের ছেলে শাহিন হোসেন পরশ, একই উপজেলার মুচড়াপাড়া পুটিমারী গ্রামের লুৎফর হোসেনের ছেলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুন নিখোঁজ রয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এর মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইফুল ইসলাম মামুনকে গত ১ জুলাই ঝিনাইদহ জেলা শহরের পবহাটী গ্রামের টুলু মিয়ার বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সাদা পোশাকের লোকজন নিয়ে যায় বলে তাঁর বাবা লুৎফর হোসেন অভিযোগ করেন।
এ ছাড়া খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা শহরের আদর্শপাড়া কচাতলা মোড়ের আবুল কালাম আজাদের ছেলে মাদ্রাসাছাত্র আবদুর রব, আরাপপুর চানপাড়ার মাদ্রাসার শিক্ষক শাহ আলমের ছেলে আজমুল হুদা, উপশহরপাড়া পাবলিক হেলথ জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন ছোট কামারকুণ্ডু গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে সোহেল রানাও নিখোঁজ রয়েছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার হরিগোবিন্দপুর গ্রামের আরিফ হোসেনের ছেলে মিলন হোসেন নিখোঁজ রয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তবে এসব নিখোঁজের ব্যাপারে এখানো থানায় কোনো ধরনের জিডি করেনি পরিবার।
ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেউ নিখোঁজ হলে আমরা সেই পরিবারকে থানায় জিডি করতে বলেছি।’