ঝিনাইদহে আরো সাতজনের সঙ্গে ভাড়া ছিলেন নিব্রাস!
ঢাকার গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলাকারী নিহত জঙ্গি নিব্রাস ইসলাম ঝিনাইদহ জেলা শহরের খোন্দকারপাড়ার একটি বাড়িতে ভাড়া ছিলেন চার মাস। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরো সাতজন। তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নিব্রাস মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ঢাকায় বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশ্রয় নেওয়া ওই বাড়ির মালিকসহ পাঁচজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাঁরা হলেন বাড়ির মালিক কাওছার আলী (৫০), তাঁর দুই ছেলে বিনছার আলী (২৫) ও বেনজীর আলী (২২), খোন্দকারপাড়ার মসজিদের ইমাম রোকনুজ্জামান ও মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ সাব্বির। ঈদের আগের দিন ৮ জুলাই দিবাগত রাত ৩টার দিকে আটক করা হয় তাঁদের। কাওছারের স্ত্রী বিলকিস নাহার বিষয়টি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
ঝিনাইদহ জেলা শহরের ওই বাড়ির আঙিনার মধ্যে চারটি টিনশেড ঘরে রয়েছে। এসব ঘরেই থাকতেন নিব্রাসসহ আটজন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৬ জুলাই ঢাকা থেকে উচ্চপর্যায়ের একটি গোয়েন্দা দল ঝিনাইদহে আসে। তাঁরা ওই কাওছারের বাড়িতে অভিযান চালান।
এ সময় ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান হাফিজুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) গোপীনাথ কানজি লালসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেদিনই কাওছার আলী, বিনছার আলী ও বেনজীর আলীকে আটক করা হয়। এরপর তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে, বাড়ির পাশে মসজিদের ইমাম রোকনুজ্জামান এবং হাফেজ সাব্বিরকে আটক করা হয়। তাঁরা দুজন ওই রাতে মসজিদে ঘুমিয়ে ছিলেন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিব্রাস স্থানীয়দের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য এসেছেন বলে জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া নিব্রাস অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতেন বলেও জানান তাঁরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ঈদের দিন বিকেলে বিলকিস নাহারকেও নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ক্যাম্পে। এরপর সেদিন রাতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আট ভাড়াটিয়ার রান্নার কাজ করা এক নারী গৃহকর্মীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকেও ছেড়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলা শহরের হামদহ খোন্দকারপাড়ায় তিন শতক জমির ওপর একটি পাকা মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। জনৈক ব্যক্তি মসজিদের নামে জমিটি দান করেছেন। ২০১৫ সালে মসজিদের ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-হাদিস-কোরান ও দাওয়া বিভাগের ছাত্র রোকনুজ্জামানকে। তাঁর বাড়ি যশোর জেলার ঝিকরগাছার নাইরা গ্রামে। মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে মসজিদের অস্থায়ী ইমাম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাঁকে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ দলের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সভাপতি ও সদর উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. সরাফত হোসেন জোয়ারদার এ মসজিদ কমিটির সভাপতি। তিনি বলেন, রোকনুজ্জামানকে নিয়মিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেখেছেন তাঁরা। অবিবাহিত এই ইমাম প্রথমে মসজিদের পাশের মন্টু মিয়ার ছাত্রাবাসে ওঠেন। সম্প্রতি তাঁর থাকার জন্য মসজিদের দ্বিতীয় তলায় একটি ঘর করে দেওয়া হয়েছে। ওই মসজিদেরই কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বাড়ির মালিক কাওছার আলী।
সরাফত হোসেন জোয়ারদার আরো বলেন, কাওছার আলীর বাড়িতে কী ঘটেছে জানা নেই তাঁর। তাঁর ভাষায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকা হাফেজ সাব্বির বরিশালের ছারছিনা মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র। আটক হওয়ার দিন রাতে মসজিদের ইমাম ও হাফেজ সাব্বির একসঙ্গে ছিলেন বলে জানান মসজিদ কমিটির এই সভাপতি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সূত্র জানায়, ইমাম রোকনুজ্জামান গুলশান হামলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় টার্গেট কিলিং এবং গুপ্তহত্যার জড়িত থাকতে পারেন। একই সঙ্গে নিহত জঙ্গি নিব্রাস ইসলামের প্রকৃত কর্মকাণ্ড ও তাঁর সহযোগীদের পরিচয়ও পাওয়া যেতে পারে।
কাওছারের স্ত্রী বিলকিস বলেছেন, মসজিদের ইমাম সাহেবের অনুরোধে চার মাস আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদ ও মোস্তাফিজুর রহমান নামের দুই ছেলেকে ঘর ভাড়া দেন। কিছু দিন পরে তাঁদের দলে যোগ দেন আরো ছয়জন ছাত্র। গৃহকর্মী তাঁদের রান্নার কাজ করতেন। তিনি আরো জানান, মাসিক দুই হাজার ৩০০ টাকায় টিনশেডের চারটি ঘর ভাড়া দেওয়া হয় তাঁদের কাছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জানা যায়, পাকাবাড়ির ভেতরে টিনশেডের আধাপাকা আরেকটি বাড়ি। মোট জমি ১০ শতক। পুরো জমি ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। টিনশেডে যাতায়াত করার জন্য আলাদা ফটক রয়েছে। বাড়ির আশপাশে রয়েছে আরো বসতি। তবে টিনশেডের ভেতরে কর্মকাণ্ড বাইরে থেকে টের পাওয়া কঠিন।
পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কোরতিপাড়ার পুরোহিত আনন্দ গোপাল ও কালীচরণপুর ইউনিয়নের মধুপুর-কাষ্টসাগরা গ্রামের রাধা-মদন-গোপাল মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস ওরফে বাবাজি হত্যার পর সব ছাত্রাবাসে তল্লাশি চালানো হয়। তবে টিনশেডের ওই বাড়ির ভেতরের খবর কেউ পায়নি।
গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন। এ ছাড়া যৌথ বাহিনীর অভিযানে ছয়জন জঙ্গি নিহত হয়।