নিখোঁজ তালিকায় বাড়িফেরা, প্রতিবন্ধী, নিহতদের নাম
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে ঝিনাইদহ জেলার ২৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে নিহত, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও বাড়িতে ফিরে আসা ব্যক্তিদের নাম পাওয়া গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার জেলাব্যাপী অনুসন্ধান করে এসব তথ্য মিলেছে। নিখোঁজ তালিকায় নাম থাকা সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর আতঙ্কে সময় কাটছে। জেলার পুলিশও জানিয়েছে, তালিকার ২৪ জনই এখন বাড়িতে অবস্থান করছে। এদের কেউ-ই জঙ্গি নয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, র্যাপিড অ্যাকশন সদর দপ্তর থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত তালিকায় ঝিনাইদহে মাত্র দুজন নিখোঁজ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- ঝিনাইদহ শহরের উপশহরপাড়া মসজিদের মোয়াজ্জিন সোহেল রানা ও সদর উপজেলার হলিধানী গ্রামের রাশেদুজ্জামান রোজ।
রোজের বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা খয়বার রহমান বলেন, গত ২ জুলাই বেলা সোয়া ১১টার দিকে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার হলিধানী বাজারের দোকান থেকে তাঁর ছেলেকে আট/নয়জন লোক গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, এর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁর ঢাকার তালতলার বাসাসহ হলিধানীর স্থানীয় বাড়িতে কয়েক দফায় তল্লাশি করেছেন। গত ৩ জুলাই তিনি ঝিনাইদহ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় ছেলের নাম আছে শুনে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে ফোনে কথা বলার সময় তিনি ভেঙে পড়েন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঝিনাইদহ পৌরসভার খাজুরা গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে দেলোয়ার হোসেন দুলাল ও একই গ্রামের গোলাম আজম পলাশের লাশ ২০১৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামের মাঠ থেকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। র্যাবের নিখোঁজ তালিকায় এ দুজনের নামও রয়েছে।
নিখোঁজ তালিকায় বিদেশে চাকরি করেন এমন ব্যক্তি এবং প্রতিবন্ধীদের নামও পাওয়া গেছে। তালিকার ৬২ নম্বরে রেজাউল করিম সোহেলের (২৯) নাম রয়েছে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতার কারণে নিজ বাড়িতেই একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে তাঁকে। এ সব তথ্য দেন তাঁর বাবা ইনজাত আলী। তালিকার ৬৩ নম্বরে মামুন রায়হানের নাম রয়েছে। তিনিও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তাঁর বোন জেসমিন জানান, প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে মামুন প্রায় হারিয়ে যেত। এর জন্য থানায় জিডি করা হয়েছিল।
এ ছাড়া কালীগঞ্জ উপজেলার হেলাই গ্রামের মাজেদুল হক (৩৫), দাদপুর গ্রামের আবু সাইদ ও বলরামপুর গ্রামের মো. হাসান আলী (৩০) নিখোঁজ নন। র্যাবের তালিকা প্রকাশের আগে থেকেই নিজ নিজ বাড়িতে আছেন তাঁরা।
এদের পরিবারের সদস্যরা সাংবাদিকদের বলেন, অভিমান করে তাঁরা বাড়ি থেকে চলে গেলে থানায় জিডি করা হয়েছিল। তাঁদের নামও উঠে এসে তালিকায় । তালিকার ২০৬ নম্বর জেলার মহেশপুরের গোয়ালহুদা গ্রামের বাপ্পি ও ২৩২ নম্বরে একই গ্রামের ওয়াফিলের নাম রয়েছে। তাঁরাও বাড়িতে রয়েছেন।
ওয়াফিলের বাবা ইয়াকুব হোসেন মোবাইল ফোনে জানান,১১ বছর বয়সে তাঁর ছেলে ও বন্ধু বাপ্পি নিখোঁজ হয়ে যায়। তারা ছয়দিন পালিয়ে ছিল। এ ঘটনায় থানায় জিডি করা হয়েছিল। তিন বছর পর র্যাবের তালিকায় নাম আছে শুনে হতবাক হয়ে পড়েন ইয়াকুব। তিনি আরো জানান, দুই-তিন দিন আগে মহেশপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাঁকে ডেকেছিলেন। র্যাবের কার্যালয় থেকে ফোন করে দেখা করার কথাও বলা হয়েছে তাঁকে।
জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কাচারিতলা গ্রামের আবদুল হোসেন বৃহস্পতিবার বিকেল ৬টার দিকে ফোনে বলেন, তাঁর জামাই মো. মতিয়ার রহমান (৩০) মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে নিজ গ্রাম সাগান্নায় চলে যান। বিপদের আশঙ্কা করে সে সময় সংশ্লিষ্ট থানায় একটি জিডি করেন তিনি। তিনি আরো জানান, ঝিনাইদহ র্যাব ক্যাম্প থেকে ফোন করে ভোটার আইডি কার্ডসহ তাঁদের যেতে বলা হয়েছে।
নিখোঁজ তালিকায় নাম থাকা মো. শফিকুল ইসলাম বিদ্যুতের বাড়ি হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আদর্শ আন্দুলিয়া গ্রামের। তিনি এক বছর ধরে নিখোঁজ ছিলেন। পরে বাড়ি ফিরে আসেন।
এ ছাড়া ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পদ্মাকর ইউনিয়নের সাবেক সদস্য আইয়ুব হোসেন জানান, তাঁর এলাকার কাশিপুর গ্রামের মো. শামীম আলী (২৬) ও মো. মোজাম্মেল মোল্লাকে (২৮) র্যাব খুঁজতে এসেছিল। তারা কেউ নিখোঁজ নন। শামীম বাড়িতে আছেন এবং মোজাম্মেল বিদেশে চাকরি করেন। তিনি আরো জানান, মোজাম্মেল জেলা শহরের হামদহ থেকে অপহরণ হয়েছিলেন। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সদর থানায় জিডি করা হয়।
আরো জানা যায়, প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী জেলার শৈলকুপা উপজেলায় নিখোঁজ থাকা আটজনের মধ্যে দুই-একজন আছেন বিদেশে। বাকিরা বাড়িতেই আছেন। এ উপজেলার হুদা মাইলমারী গ্রামের আমিজ উদ্দীনের ছেলে মাসুমকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় একটি জিডি করা হয়। পরে তাঁর ছেলে ফিরে আসে। একই উপজেলার চরআউশিয়া গ্রামের নাঈমের নাম র্যাবের তালিকায় ৮৪ নম্বরে দেখা যায়। তাঁর পরিবারের দেওয়া তথ্যমতে, নাঈম বিদেশে চাকরি করছেন। শৈলকুপার সাতগাছি গ্রামের মো. মজিবর খা (২৮), বোয়ালিয়ার উজ্জ্বল, ওয়াসিম আকরাম (২৫), উমেদপুরের মো. রবিউল ইসলাম (২৫), বাজারপাড়ার মো. রফিকুল ইসলাম (২২) ও কৃষ্ণপুর গ্রামের মো. তোতা (২৫) মিয়া নিখোঁজ নন বলে পরিবারগুলো থেকে জানানো হয়েছে।
সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, র্যাবের তালিকায় নিখোঁজ থাকা কালুহাটী গ্রামের মো. আশিকুর রহমান রিপন (২৪) ও আক্তারুজ্জামান বাড়িতেই আছেন। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে এঁরা নিখোঁজ বলে থানায় জিডি করা হয়েছিল।
ঝিনাইদহ জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেছেন, র্যাবের প্রকাশ করা তালিকার মধ্যে ২৪ জন ফিরে এসেছেন। এঁদের মধ্যে মাত্র পাঁচজনকে পাওয়া যাচ্ছে না। এঁরা হলেন- সদরে বড় কামারকুণ্ডু গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে মোয়াজ্জিন মো. সোহেল রানা, কালীগঞ্জের হেলাই গ্রামের মো. মাজেদুল হক (৩৫), শৈলকুপার বোয়ালিয়া গ্রামের উজ্জ্বল (২৫), ওমেদপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম, কৃঞ্চপুর গ্রামের তোতা মিয়া ( ২৫)। তিনি আরো জানান, যাদের নাম তালিকায় দেখা যাচ্ছে তাঁরা কেউ জঙ্গি নন।
এ বিষয়ে স্থানীয় র্যাব ক্যাম্পে যোগাযোগ করা হলে ডিউটি অফিসার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন বলেন, তালিকার বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না।
গ্রাম থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয় দিয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের দীর্ঘদিনেও কোনো সন্ধান মিলছে না। তারা হলো জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ষাটবাড়িয়া মসজিদের ইমাম আবদুল হাই (৩৫), সদর উপজেলার চাপড়ী গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র হাসান আলী, পাগলাকানাই ইউনিয়নের কোরাপাড়া বটতলা এলাকার হোসেন আলী মোল্লার ছেলে জাহিদ ওরফে কোবরা জাহিদ, শৈলকুপা উপজেলার চরফুলহরি গ্রামের আমিরুল ইসলাম মণ্ডলের ছেলে শাহিন হোসেন পরশ, জেলা শহরের আদর্শপাড়া কচাতলার আবুল কালাম আজাদের ছেলে মাদ্রাসাছাত্র আব্দুর রব, জঙ্গি নিব্রাস ইস্যুতে নিখোঁজ জেলা শহরের সোনালীপাড়ার সাবেক সেনা সদস্য কওছার আলী তার দুই ছেলে বিনছার আলী ও বেনজির আলী, হাফেজ রোকনুজ্জামান ও শিশু হাফেজ সাব্বির, আরাপপুর চানপাড়ার মাদ্রাসার শিক্ষক শাহ আলমের ছেলে আজমুল হুদার সন্ধ্যান আজো পাওয়া যায়নি বলে জানানো হয়েছে।