ছবি আত্মহত্যার কথা বলে?
একটি মৃতদেহের কয়েকটি ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গলার ডান দিকের ওপরের অংশ দুটি লাল ক্ষতচিহ্ন। বাম দিকেও একই অংশেও কালো হয়ে থাকা ক্ষতচিহ্ন। আছে চেপে ধরার মতো দাগ। আর বাঁ হাতে লম্বা কয়েকটি কাটা দাগ।
ছবিগুলো তোলা হয় গত বছর ১৩ নভেম্বর, রাজধানীর ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালে। সময় তখন বিকেল ৪টা। ছবিগুলো তোলেন যে মেয়েটি মারা গেছেন তাঁর ছোট মামা কাজী শামসুর রহমান।
স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়েটির স্বজনদের জানিয়েছে, মেয়েটি তাঁর ওড়না বাথরুমের ভেন্টিলেটরের সঙ্গে বেঁধে ঝুলে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন বলছে, এটি আত্মহত্যা। পুলিশও ‘তদন্ত শেষে’ জানিয়েছে, মেয়েটি আত্মহত্যাই করেছে।
তবে এই ছবিগুলো আর সঙ্গে আরো কিছু প্রশ্ন তুলে মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তাঁদের মেয়ে ডা. শামারুখ মাহজাবীনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আত্মহত্যা করেননি।
ডা. শামারুখের বাবা যশোর ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সহকারী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম। তিনি জানান, অনেক শখ করে একমাত্র মেয়ে ডা. শামারুখের বিয়ে দিয়েছিলেন। সম্বন্ধ করেছিলেন একজন সাবেক সংসদ সদস্যের পরিবারের সঙ্গে। ভেবেছিলেন, মেয়ের আজীবন সুখের ব্যবস্থা করে দিলেন। একদিন দুপুর বেলা হঠাৎ আসা একটি ফোন তাঁর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়।
২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর রাতে নুরুল ইসলামকে ফোন করেন শামারুখ। জানান, তাঁর ওপর নির্যাতন চলছে। শ্বশুরবাড়ির মানুষরা তাঁকে মেরে ফেলবে, এমন আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। পরের দিন ১৩ নভেম্বর অফিসের কাজ গুছিয়ে সন্ধ্যার ফ্লাইটে ঢাকা যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন শামারুখের বাবা। সেদিন দুপুরে ঢাকা থেকে ফোন আসে। জানানো হয়, আত্মহত্যা করেছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে।
গত বছরের ১৩ নভেম্বর রাজধানীর ধানমণ্ডির একটি বাসা থেকে শামারুখের লাশ উদ্ধার করা হয়। সেখানে তিনি স্বামী হুমায়ুন সুলতান, শ্বশুর যশোর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য টিপু সুলতান ও শাশুড়ি জেসমিন আরার সঙ্গে বসবাস করতেন।
শামারুখের মৃত্যুর পর তাঁর বাবা নুরুল ইসলাম বাদী হয়ে মেয়েকে শ্বাসরোধে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা করেন। নানা ঘটনা পরিক্রমায় প্রথম দফা ময়নাতদন্ত শেষে পুলিশ এসে আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে নুরুল ইসলাম নারাজি দিলে আদালত লাশ উত্তোলন করে পুনরায় ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। সে সময় করা এক্সরে প্রতিবেদনে শামারুখের শরীরের কোনো হাড় ভাঙা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া ভিসেরা প্রতিবেদনে জানানো হয়, শরীরের অনেক স্থানে পচন ধরে যাওয়ায় কিছু বলা যাচ্ছে না।
এর মধ্যে জামিনে মুক্ত হন শামারুখের শ্বশুর ও শাশুড়ি। সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল জামিন পান তাঁর স্বামী হুমায়ুন সুলতান।
শামারুখের বাবা নুরুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘একজন ডাক্তার যদি আত্মহত্যাও করে থাকে, তবে কেন করলে সেটাও খুঁজে বের করা দরকার। অথচ সেটা করা হয়নি। আমার মেয়েটাকে বিসিএস দিতে দেয়নি, এফসিপিএস করতে দেয়নি। সেই মেয়েটা ছোট একটা বাথরুমে কীভাবে আত্মহত্যা করল। সেখানকার কোনো আলামত সংগ্রহ না করেই প্রতিবেদন দিয়ে দিল?’
‘আমি অনেক ল রিপোর্ট পড়ে দেখেছি। দুই বছর পর ডেডবডি তোলার পরও সেখান থেকে অনেক আলামত পাওয়া যায়। আর আমার মেয়েটাকে কবর দিয়ে আসার ১৯ দিন পর কবর থেকে তোলা লাশ নাকি পচে গেছে। শীতকালে নাকি ১৯ দিনের মধ্যেই লাশ পচে গেছে। প্রতিবেদনে দিয়েছে লাশ নাকি পচে-গলে গেছে, কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। নো কমেন্ট দিয়েছে,’ যোগ করেন শামারুখের বাবা।
নুরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, মামলা করার সময় যাদের সাক্ষ্যের কথা বলেছিলেন, তাঁদের বাদ দিয়ে, মামলার বিবরণে তিনি যা লিখেছিলেন, সেসব কিছু আমলে না নিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
বাসা থেকে অল্প দূরত্বে থানা থাকলেও কেন পুলিশ আসার আগেই লাশ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নামিয়ে ফেলল, কেন সবচেয়ে কাছের হাসপাতালে না নিয়ে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হলো এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর না মিলিয়েই তদন্ত কর্মকর্তা একে আত্মহত্যা হিসেবে প্রতিবেদন দিয়েছেন বলেও দাবি করেন শামারুখের বাবা।
ফেসবুকে শামারুখের ছবিগুলো পোস্ট করেছেন তাঁর ভাই শরীফ বাবু। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কেসটা নিয়ে আমরা কী করব, সেটা এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। কিছু চিন্তাই করতে পারছি না। পুলিশ খুনের কোনো আলামতই পায়নি। অথচ তাঁর (শামারুখ) তো আত্মহত্যা করার কথা না। সে জলি একটা মেয়ে।’
পরের দফায় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে শরীফ বাবু বলেন, ‘আমরা এক্সরে করেছিলাম। ৯৯ পারসেন্ট সুইসাইডের কেসে গলার পেছনের হাড় ভাঙা থাকে। কিন্তু ওর ছিল না।’
শরীফ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, টিপু সুলতানের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখাতে। কিন্তু তাঁর তো আরো অনেক লবিং আছে। টিপু সুলতান টাকা-পয়সা খরচ করেছেন। আমি হোপলেস। এই যে ভিডিও ফুটেজে অনেকের চেহারা ধরা পড়তেছে। কই কেউ তো কিছু বলতেছে না। (পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার টিএসসিতে ঘটা নারী হেনস্তার ঘটনা উল্লেখ করে)।’
আক্ষেপ করে শরীফ বলেন, ‘যাই করি তারে (শামারুখ) তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না।’
শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিজেরাই শামারুখের লাশ নামিয়েছেন উল্লেখ করে শরীফ বলেন, ‘দুজন শিক্ষিত মানুষ। একজন লইয়ার এবং একজন ডাক্তার। তারা কি পুলিশ না ডেকে নিজেরাই লাশ নামাবে। আপনি বলেন? মামলার আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) ঘটনাস্থলেও যায়নি। না গিয়েই সে প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছে।’
শামারুখ যে বাথরুমে গলায় ফাঁস দিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে শরীফ বলেন, ‘ছোট্ট একটা বাথরুম। সেখানে ভেন্টিলেটরটা হলো পাঁচ ফুুট। তার (শামারুখের) হাইট ৫ ফুুট৩ ইঞ্চি। এই হাইটে ভেন্টিলেটরে তাঁর ফাঁস দেওয়া কীভাবে সম্ভব। বলেন?’
এ বিষয়ে জানতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) রমনা ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুন্সী রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে এনটিভি অনলাইন।
তড়িঘড়ি করে কথা বলে কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু নিজের কথাটুকু বলেই ফোন কেটে দেন রুহুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘এটা কোর্টের বিষয়। কোর্টের কাছে সব আছে। তদন্তের বিষয়ে এখন আমার কাছে কিছু নাই। গো টু কোর্ট। আমার কাছে কিছু নাই। থ্যাংকিউ ভেরি মাচ।’
হুমকি-ধমকি
শামারুখের মৃত্যুর পর মামলা করার পর থেকে তাঁদের পরিবারকে বিভিন্ন ভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান শরীফ। বলেন, ‘নানা রকম থ্রেট দেওয়া হয়। যেমন ধরেন ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন লোকজনের মাধ্যমে আব্বার নামে মিথ্যা অভিযোগ লিখে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অ্যাপ্লিকেশন পাঠাচ্ছে।’
এ ছাড়া তাঁদের পক্ষে কথা বলায় মনিরামপুরের আদম বাহিনী তাঁর এক বন্ধুকে ডেকে নিয়ে হুমকি দিয়েছে বলেও জানান শামারুখের ভাই।
শামারুখ মাহজাবীন ঢাকার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নবম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন। মৃত্যুর দেড় বছর আগে পারিবারিকভাবে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে ধানমণ্ডির ৬ নম্বর রোডে ভাড়া বাসায় শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীর সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি।