পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে বিভাগীয় সংহতি সমাবেশ
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পূর্তিতে তা বাস্তবায়নের দাবিতে ময়মনসিংহে বিভাগীয় সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ সোমবার (৫ জুন) শহরের টাউনহলে অ্যাডভোকেট তারেক স্মৃতি অডিটরিয়ামে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাতের সভাপতিত্বে ও নজরুল ইসলাম চুন্নুর সঞ্চালনায় সংহতি সমাবেশে বক্তব্য দেন বিভিন্ন প্রগতিশীল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আজ ময়মনসিংহে বাম প্রগতিশীল নেতারা ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী এক দাবিতে একত্রিত হয়েছে—যা আনন্দের। ১৯৭১ সালের অপূর্ণতা পূর্ণতা পেয়েছিল এই চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ চুক্তি বাস্তবায়ন সহজ ছিল না, কিন্তু তার ফল আসছে না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে পাহারের সমস্যা সমাধান না করে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেন, যার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। এরশাদের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছিলাম। খালেদ জিয়া জনচাপে উদ্যোগ নিলেও চুক্তি করেননি। শেখ হাসিনার উদ্যোগে চুক্তি হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সংঘাত জিইয়ে রাখার ফলস্বরূপ আজ সেখানে কুকি-চিনের আনাগোনা, সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে দেশীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী। যা পাহাড়-সমতল সর্বত্র অশান্তির কারণ।’
রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, ‘এ বছর প্রস্তাবিত বাজেটে কোথাও আদিবাসীদের কথা নেই। অথচ আমরা চেয়েছিলাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ থাকবে। আজ পাহাড়ে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল-মোটেল রিসোর্ট হয়েছে—যার বদলা পাহাড়িরা দিচ্ছে। এসব উন্নয়ন পাহাড়ের মানুষের জন্য নয়, বাঙালিদের ভোগের জন্য। নিরাপত্তার চশমা দিয়ে দেখে বিচ্ছিন্নতার জিগির তুলে সেখানে সেনা শাসন জিইয়ে রাখা চলবে না।’
রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, চুক্তির দীর্ঘ ২৫ বছর অতিবাহিত হচ্ছে। আমাদের আর বসে থাকলে হবে না। আমাদের সবাইকে এক হয়ে আমাদের দাবির পক্ষে লড়তে হবে। আজ আমাদের একটাই দাবি—এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতেই হবে।’
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি ছিল বিধায় সেখানে শান্তি চুক্তি করতে হয়েছিল। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে কেন্দ্র করেই অশান্তির বীজ দানা বেঁধেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ৭২-এর সংবিধানে সে বিরোধ জিইয়ে রাখা হয়েছে। সরকারের ভাষ্যমতে, চুক্তির ৭২টি শর্তের মধ্যে ৪৮টি বাস্তবায়ন করেছে। যেখানে আমরা বলছি ২৫টি চুক্তিতে বলাছিল পাহাড়ি অঞ্চল হবে আদিবাসী অধ্যুষিত। কিন্তু আজ সে অঞ্চলে প্রচুর স্যাটেলার, যা চুক্তিবিরোধী। পাহার সমতলে কোথাও ভূমি অধিকার নেই। উন্নয়নের নামে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আজ সময় এসেছে, সবাইকে সব অধিকারের দাবিতে একত্রিত হয়ে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম বেগবান করার।
জাসদের ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের সংহতি সভা আজ আমরা ময়মনসিংহে করছি, কারণ আমরা আদিবাসী, পাহাড়িদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলাম ৭১-এর যুদ্ধে। আজ আমরা তাদের দাবির সঙ্গে একাত্ম। আমরা সমতলের মানুষ পাহারের অধিবাসীদের অধিকারের নিশ্চয়তা চাই। সব জাতিগোষ্ঠীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশ আজ শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক, সাম্রাজ্যবাদী অবস্থান গ্রহণ করেছে। শান্তি শৃঙ্খলা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পাহাড়ের ভূমি সমস্যা সমাধান করতে হবে, চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।’
বাসদনেতা কমরেড খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, ‘প্রশ্ন আসে ময়মনসিংহে কেন আমরা সমাবেশ করছি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে। কিন্তু সংবিধানে আদিবাসীদের মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়নি, যা আমাদের জন্য লজ্জার। আজকে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে পাহাড়ি, আদিবাসীদের সাংবিধানিক মর্যাদা এবং চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিত করলেই স্বাধীনতা বাস্তবায়ন হবে। এ চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমাদের এ সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।’
জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা বলেন, ‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। আজও প্রধানমন্ত্রী তিনি। তবুও কেন চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। আজ আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না৷ ৭১-এর যুদ্ধে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, আদিবাসীরাও যুদ্ধ করেছে, তবুও কেন তারা সাংবিধানিক মর্যাদা পাবে না, চুক্তি কেন বাস্তবায়ন হবে না? পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেই সমতলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। দ্রুত ভূমি সমস্যা বাস্তবায়ন করতে হবে, চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।’
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ২৫ বছর আগে যে চুক্তি হয়েছিল, তখন আমরা আশা করেছিলাম—পাহাড়ে শান্তি আসবে। ২৫ বছর পর পাহাড়ে শান্তি আসেনি। সরকার ক্ষমতায় থেকেও এ চুক্তি বাস্তবায়ন না করা হতাশা জনক।’ এ বাজেটে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকার বরাদ্দ দিবে বলেও তিনি আশা রাখেন।
সংহতি সমাবেশ আরও বক্তব্য দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতিনেতা দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য ইউজিন নকরেক প্রমুখ।