ডিএনসিসির অ্যাপে যেভাবে মিলবে দাফন ও পুরোনো কবরের তথ্য
কোটির বেশি জনসংখ্যার ঢাকায় একটি বড় সমস্যা আবাসন। অট্টালিকার প্রতিযোগিতায় এক টুকরো ফাঁকা জায়গা মেলা ভার। নগরবাসী যেখানে একটু দম ফেলে হাঁটাহাঁটি করবেন বা একটু জিরিয়ে নেবেন, সেরকম খোলা জায়গার পরিমাণও দিন দিন কমছে। সেখানে জীবনের শেষ যাত্রায় স্থায়ী সাড়ে তিন হাত জায়গা পাওয়া অসম্ভব।
রাজধানীর দুটি সিটি করপোরেশন অবশ্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কবর সংরক্ষণের সুযোগ রেখেছে। কিন্তু অর্থের বিবেচনায় অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সে সুযোগ নিতে পারবেন না। প্রশ্ন জাগতেই পারে, তাহলে এত সংখ্যক মৃত্যু-দাফন তথা কবর ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশন কী ব্যবস্থা নিয়ে থাকে?
নির্দিষ্ট সময় পর পুরোনো কবরেই কি নতুন কবর দেওয়া হয়? পুরোনো কবরেই যদি নতুন কবর দেওয়া হয়, তাহলে স্বজনরা কাছের মানুষের কবর খুঁজে পান কীভাবে? অথবা যাদের কবর দেওয়ার প্রয়োজন হয় তাদের সিটি করপোরেশন সেবা কীভাবে দেয়? এর সমাধান মিলবে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সহযোগিতায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ‘কবর ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে’।
যে মাধ্যমে সেবা নেওয়া যাবে
ডিএনসিসি আপাতত ছয়টি কবরস্থানকে এই সিস্টেমের আওতায় এনেছে। সেগুলো হলো—বনানী, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী, রায়ের বাজার, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর ও উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর। অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের মুঠোফোন অ্যাপ্লিকেশনে (অ্যাপ) খুব সহজেই জানা যাবে কোথায় কবরের স্থান ফাঁকা আছে, পূর্বের কবর কোথায় অবস্থিত, করা যাবে নতুন কবরের জন্য নিবন্ধন। এছাড়া এ সংক্রান্ত নানান তথ্য রয়েছে অ্যাপটিতে। পর্যায়ক্রমে অ্যাপটির মাধ্যমেই পাওয়া যাবে দাফনের সনদ।
মুঠোফোন অ্যাপ
গুগল প্লে স্টোরে ‘Graveyard Management DNCC’ লিখে সার্চ করলেই অ্যাপটি পাওয়া যাবে।
অ্যাপে নিবন্ধন প্রক্রিয়া
অ্যাপটি ইনস্টল করে প্রথমবার চালু করলে কিছু অনুমতি দিতে বলবে। যা মূলত অধিকাংশ অ্যাপে প্রথমবার চালু করার পর চাওয়া হয়। এরপর নিবন্ধন ফর্ম দেখাবে। যেখানে মুঠোফোন নম্বর, ইংরেজিতে নাম ও ঠিকানা দিয়ে ‘নিবন্ধন সম্পন্ন করুন’ নির্বাচন করলেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে।
দাফনের আবেদন
অ্যাপে প্রবেশের পর উত্তর সিটির অধীনে ছয়টি কবরস্থান পাওয়া যাবে। যে কবরস্থানে দাফন করতে হবে তা নির্বাচন করুন। বাম পাশে নিচে ‘দাফনের আবেদন’ বাটন পাওয়া যাবে। বাটনটি চাপলে আবেদনের তালিকা দেখাবে (যদি আগে করা থাকে)। ঠিক নিচেই ‘নতুন আবেদন’ অংশ রয়েছে। যেখানে কাঙ্ক্ষিত তথ্য দিয়ে ‘সংরক্ষণ করুন’ নির্বাচন করলে আবেদন সম্পন্ন হবে।
দাফনের জন্য এই আবেদন ফর্মে তারকা (*) চিহ্নিত তথ্য অবশ্যই পূরণ করতে হবে। সেগুলো হলো—কবরের ধরন (আপাতত সাধারণ), মৃত ব্যক্তির ধরন (সাধারণ, বেওয়ারিশ), মৃত ব্যক্তির নাম (ইংরেজিতে), বাবার নাম, মায়ের নাম, লিঙ্গ, মৃত্যুর তারিখ, জন্মতারিখ, মৃত্যুর কারণ (বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ আছে), মৃত্যুর স্থান (বাড়ি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, অন্যান্য), জেলা, উপজেলা, জাতীয়তা ও মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক।
মৃত ব্যক্তির তথ্য অনুসন্ধান
দাফন যে কবরস্থানে করা হয়েছিল, তা নির্বাচন করতে হবে। ডান পাশে নিচের দিকে ‘তথ্য অনুসন্ধান’ অপশনটি রয়েছে। যেখানে প্রবেশ করে নাম, কবর নম্বর, কবর দেওয়ার তারিখ বা মৃত্যুর তারিখ—যেকোনো একটি দিয়ে অনুসন্ধান করা যাবে। নাম বা তারিখ ইংরেজিতে লিখতে হবে। আপাতত এখানে মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ, কবর দেওয়ার তারিখ ও কবর নম্বর দেখাবে।
কবর ফি ও অন্যান্য সাধারণ তথ্য
কবরস্থানভেদে প্রতিটির সাধারণ কিছু তথ্য দেওয়া আছে। কত সালে স্থাপিত হয়েছে, কবরস্থানের আয়তন কত, মোট কবর কয়টি, এর মধ্যে সাধারণ ও সংরক্ষিত কবর কয়টিসহ মোট দাফন ও নতুন কতটি দাফন করা যাবে—এসব তথ্য পাওয়া যাবে। এছাড়া দাফনের নিবন্ধনের জন্য কত টাকা লাগবে তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নিবন্ধন ফি সব কবরস্থানের জন্য ৫০০টাকা নির্ধারিত হলেও ১৫ ও ২৫ বছর মেয়াদে কবর সংরক্ষণের জন্য স্থানভেদে আলাদা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রতিটি কবরস্থানের জন্য আলাদা মুঠোফোন নম্বর ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম দেওয়া আছে।
প্রয়োজনীয় নথি
সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া শেষ করতে যেসব নথির প্রয়োজন হতে পারে—
> হাসপাতালে মারা গেলে মৃত্যুর সনদপত্র (চিকিৎসকের)
> মৃতব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি
> যদি মৃতব্যক্তি ১৮ বছরের কম বয়সী হয়, তাহলে মা অথবা বাবার পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি
> অভিভাবকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধনের ফটোকপি
> বিদেশে মারা গেলে মৃতব্যক্তির পাসপোর্টের ফটোকপি
> আত্মহত্যা বা খুন করা হলে মৃতব্যক্তির ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এবং পুলিশের ছাড়পত্র
কবরস্থানে যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে
কবরস্থানভেদে কিছু সুবিধায় ভিন্নতা থাকতে পারে। যেমন—ওজুর ব্যবস্থা, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, মৃতদেহ বহনের জন্য খাটিয়ার ব্যবস্থা, জানাজার ব্যবস্থা, ইমামের ব্যবস্থা, মসজিদের ব্যবস্থা, বিশ্রামকক্ষ। নির্দিষ্ট সময়ে এসব সুবিধা থাকছে কি না, তা উল্লেখ করা হয়েছে। আগে থেকেই জেনে নিলে প্রয়োজনের সময় সমস্যায় পড়তে হবে না।
ফ্রিজার ভ্যান
অ্যাপটিতে প্রবেশ করলে নিচের দিকে ‘ফ্রিজার ভ্যান’ ও ‘মৃতদেহ গোসল’ দুটি অপশন পাওয়া যাবে। যেখানে কিছু সংস্থার নাম, মোবাইল নম্বর ও ওয়েব ঠিকানা দেওয়া আছে।
ব্যবহারকারীর প্রতিক্রিয়া
একটি বেসরকারি আইটি কোম্পানির ভিজ্যুয়াল আইডেন্টিটি ডিজাইনার তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘অ্যাপটির ফন্ট, লে-আউটসহ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা মোটামুটি ভালো মনে হয়েছে। যতটুকু ব্যবহার করেছি তাতে অ্যাপটি হালকা তথা ব্যবহার উপযোগী লেগেছে। তবে ফ্রিজার ভ্যানের জন্য যেসব নম্বর দেওয়া হয়েছে সেগুলো দেখা গেলে ভালো হতো। এখন যেভাবে দেওয়া হয়েছে তাতে নম্বর চাপলে সরাসরি ফোনের ডায়ালে চলে যায়।’
চাকরিপ্রত্যাশী ও কিছুদিন গণমাধ্যমে কাজ করা তাসমিয়া আফরোজ বলেন, ‘মৃত্যু নিশ্চয়ই ভয়ংকর বিষয়। স্বজনরা যখন এর সম্মুখীন হয় তখন কতই না ঝামেলায় পড়তে হয়! অ্যাপটির মাধ্যমে তা সমাধান করা গেলে বেশ ভালো হবে।’
বেসরকারি সফটওয়্যার কোম্পানির সফটওয়্যার ডেভেলপার মকদুম রশিদ বলেন, ‘অ্যাপে নিবন্ধন করার পর নিজের প্রোফাইল দেখার সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে লগ-ইন তথ্য দেখা যায় না এবং পরিবর্তনের সুযোগ থাকছে না। তাছাড়া অন্য কোনো ফোনে নতুন করে লগ-ইন করা যায় না। প্রতিবারই নাম, মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। যা বেশ ঝামেলার। এছাড়া প্রাথমিক অবস্থায় অ্যাপটিকে মোটামুটি ভালোই মনে হয়েছে।’
সদ্য মাস্টার্স শেষ করা রাকিবুল হাসান দাফন ও কবরস্থান সংক্রান্ত এরকম অ্যাপ আগে দেখেননি বলে জানান। তিনি বলেন, ‘অ্যাপটি গোছানোই মনে হয়েছে। বিশেষ করে কবরস্থানে ওজু বা মরদেহ গোসলের ব্যবস্থা আছে কি না, এরকম তথ্য তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।’
সতর্কতা
যেহেতু এ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশ এই প্রথম, তাই কিছুক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। সেরকম কিছু হলে কবরস্থানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। অথবা এই ওয়েব ঠিকানার এই লিঙ্কে বিস্তারিত দেখে নেওয়া যেতে পারে।