বিএনপিনেতা হাবিবের সাজার বিরুদ্ধে আপিল শুনানি ৩ মার্চ
বিচারপতিকে নিয়ে মন্তব্য করায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবের ‘আদালত অবমাননাকর বক্তব্যের অভিযোগে হাইকোর্টের দেওয়া পাঁচ মাসের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি আগামী ৩ মার্চ দিন নির্ধারণ করেছেন। আজ রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের চেম্বার আদালত আগামী ৩ মার্চ বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ বেঞ্চের শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন।
আদালতে আজ হাবিবের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।
গত ২২ নভেম্বর পাঁচ মাসের কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট। ওদিন দুপুরে হাইকোর্ট কক্ষে ল্যাপটপে ভিডিও চালিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত টকশোতে হাবিবুর রহমান হাবিবের দেওয়া বক্তব্য দেখানো হয়।
এ সময় আদালতের ডায়াসে দাঁড়িয়ে থাকা হাবিবুর রহমান হাবিবকে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ জিজ্ঞেস করেন, ‘যেটা দেখলেন এটা কি আপনার বক্তব্য? শপথ করে বলুন।’ জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমি শপথ করেই বলছি এটা আমার বক্তব্য। এ সময় হাবিব হাইকোর্টকে বলেন, আমাকে অনুমতি দিলে আমি কিছু বলতে চাই।
আদালত অনুমতি দিলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, ২০০৯ সালে আমি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখন আমার কাছে কোন টাকা ছিল না। এক কোটি টাকার উপরে প্রয়োজন ছিল আমার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে। তখন সেসময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাকে সিঙ্গাপুর পাঠিয়েছিলেন লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করাতে। কিন্তু, পরবর্তীতে আমার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট লাগেনি। এখন সেই খালেদা জিয়ার জীবন বিপন্ন। ওনার লিভারে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমি আগেই বলেছি খালেদা জিয়ার জন্য লিভার লাগলে আমি আমার লিভার দিয়ে দিবো। খালেদা জিয়া আমার কাছে মায়ের মতো। আমার মাকে যদি কেউ কটু কথা বলে, তাকে তো আমি ছাড়ব না। ওনাকে এই বয়সে সাজা দেয়া হয়েছে। ওনার প্রতি আমার আবেগ থেকে আমি ওই (আদালত অবমাননার অভিযোগে আনা) কথাটা টিভি টকশোতে বলেছি। এতে ১০০ বছর সাজা হলেও হোক।
একপর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে হাবিবুর রহমান হাবিব হাইকোর্টকে বলেন, আমি একটা ভাড়া বাসায় থাকি, যে বাসায় লিফট নেই। আমি সারাজীবন স্বচ্ছ রাজনীতি করেছি। আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে বিচার দিয়ে যাচ্ছি, যে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আমাকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেই গাড়ি পোড়ায়নি। আজ দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে যেভাবে বিচার করা হচ্ছে, মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে এটা চলতে পারে না।
এ সময় হাবিবুর রহমান হাবিব হাইকোর্টকে বলেন, আমি আইন-আদালত মানি। কিন্তু অন্যায় রায়-বিচার আমি মানি না। আপনারা সবকিছু বিবেচনা করে যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করবেন। আমাকে সাজা দিলেও আমি আপনাদের সালাম জানাবো এবং আমি সেই সাজা মাথা পেতে নেব।
একপর্যায়ে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. বশির উল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘আপনার কথা শুনলাম। আপনার কথায় আবেগ আছে। কিন্তু এটা সবারই মনে রাখা উচিৎ যে, বিচারক ও বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছ থেকে এমন বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য। যে বক্তব্য পুরো বিচারবিভাগের মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করেছে। আদালতের কোন রায়ে সন্তুষ্ট না হলে সে রায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোন বিচারকের বিরুদ্ধে হুমকি দেয়া আদালত অবমাননাকর। প্রত্যেকেরই তার নেতার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে হাবিবুর রহমান হাবিবের যে বহিঃপ্রকাশ তা পুরো বিচার বিভাগের মর্যাদার প্রতি অবমূল্যায়নকর।’
এ সময় হাইকোর্ট বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা সমাজের শিক্ষক। তারা নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে একত্রিত করতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে স্মরণ করতে পারি। তিনি কিভাবে একটা জাতিকে একত্রিত করেছিলেন। এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ রাজনীতিবিদরা নেতৃত্বের এই শক্তিটা ধারণ করতে পারেন। সুতরাং একজন রাজনীতিবিদের এটাই ভাবা উচিত যে, তিনি সমাজের একজন শিক্ষক।’
হাবিবুর রহমান হাবিবকে হাইকোর্ট জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা? জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ আমি মুক্তিযোদ্ধা তবে সার্টিফিকেট নেইনি। তখন আদালত বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে এমন (টকশোতে দেয়া) মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রত্যাশিত।
কিছু কিছু শাস্তি সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে উল্লেখ করে হাবিবুর রহমান হাবিবের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট বলেন, উনি যেভাবে বলেছেন তা আমাদের হৃদয়কেও ছুয়েছে। উনি সাহসের সঙ্গে বলেছেন। উনি মিথ্যা বলেন নাই, উনি অস্বীকার করেন নাই। এরকম নজির আমরা সাধারণত দেখি না। উনি ওনার বলার অবস্থান থেকে পিছিয়ে যাননি। উনি টকশোতে যা বলেছেন, সেটা এখানে আবার দৃঢ়তার সাথে স্বীকার করেছেন। উনি বলেছেন, উনি ওনার নেত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। উনি এটাও বলেছেন যে, উনি তাকে মায়ের মত ভালোবাসেন। এটা ওনার আবেগের প্রকাশ। তবে বিচারবিভাগ সবকিছু দেখে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারে না এবং এতে সমাজে ভুল বার্তা যায় উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, আমরা একটা শাস্তি দিয়েছি, যেটাতে এই বার্তা যাবে যে আদালত ও বিচারককে নিয়ে এভাবে বলা যায় না। কথার একটা সীমা থাকতে হয়।
হাইকোর্টে আদালতে হাবিবুর রহমান হাবিবের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফজলুর রহমান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট মামুন মাহবুব, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কে এম মাসুদ রুমি। আর বিটিআরসির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খন্দকার রেজা-ই-রাকিব।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর তৎকালীন বিচারক মো. আখতারুজ্জামান। এরপর ২০১৯ সালে মো. আখতারুজ্জামান হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
এই বিচারপতিকে নিয়েই ‘অবমাননাকর বক্তব্যের’ অভিযোগে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুলসহ স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেন হাইকোর্ট। যেখানে হাবিবুর রহমানকে তার বক্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হাইকোর্টে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়।