পরিবহণ খাতে চাঁদা টিআইবির হিসাবের চেয়েও বেশি
পরিবহণ খাতে বছরে টিআইবির হিসাবের চেয়ে বেশি চাঁদা আদায় হয় বলে জানিয়েছেন একজন পরিবহণ শ্রমিক নেতা৷ তার মতে, এই খাতে টিআইবি ৪৬ ভাগ সেবাগ্রহীতাকে চাঁদা দিতে হয় বললেও বাস্তবে ৯০ ভাগকে চাঁদা দিতে হয়৷ আর ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পরিবহণে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়৷ তাদের মতে পরিবহণ খাতে যেকোনো ধরনের চাঁদা পণ্যমূল্যের ওপর প্রভাব ফেলে৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গত ৫ মার্চ ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ ব্যবসায় শুদ্ধাচার’শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে এক হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়৷ এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা৷
অবশ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে৷ বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘‘বিআরটিএ কিংবা মন্ত্রণালয়ে কোনো মৌখিক, লিখিত অভিযোগসহ কোনো তথ্য না থাকা সত্ত্বেও টিআইবি অসত্য প্রতিবেদন তৈরি করেছে৷ বিআরটিএর সেবাগুলো ডিজিটাল হয়ে যাওয়ায় সশরীর অফিসে যেতে হয় না৷ ফলে ঘুস দুর্নীতিও হয় না৷”
আর সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ‘‘প্রকৃতপক্ষে মালিক সংগঠন নির্ধারিত পরিচালনা ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ কখনো আদায় করে না৷ এর বাইরে কেউ অবৈধ চাঁদা আদায় করলে তা কঠোর হস্তে প্রতিহত করা হয় এবং অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷”
টিআইবি জরিপের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন তৈরি করে৷ জরিপে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহণ ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ মালিক সংগঠনের নেতাদের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত৷ ২২টি কোম্পানির কাছে ৮১.৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে৷ আর তাদের ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের৷
জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী বা শ্রমিকদের ৪০.৯ শতাংশের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে৷ সিটি সার্ভিসের কর্মী বা শ্রমিকদের ৪০.৪ শতাংশ বলেছেন, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে৷ যাত্রীদের ৬০.৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন৷
গবেষণার ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘চাঁদাবাজির এই হিসাব খুবই রক্ষণশীল৷ বাস্তবে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি চাঁদাবাজি হয়৷ এই চাঁদার ভাগ নানা পর্যায়ে যায়৷ যেহেতু খাতটি রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে, সেহেতু চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে৷”
ড. ইফতেখারুজ্জামানের কথার সত্যতা পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিবহণ শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. হানিফ খোকনের কথায়৷ তিনি বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিআইবি বলেছে ফিটনেস, রুট পারমিট, রেজিস্ট্রেশন করার জন্য ৪৬ ভাগকে উৎকোচ দিতে হয়৷ বাস্তবে ৯০ ভাগকে উৎকোচ দিতে হয়৷ ভয়ে তারা প্রকাশ করে না৷”
হানিফ খোকনের মতে, বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স এখন অনলাইনে দুই-তিন দিনে হয়ে যায়৷ বাস্তবতা হলো চার বছরেও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না৷ এখানেও ঘুস আছে৷
হানিফ খোকন জানান, ‘‘পরিবহণ খাতে এখন নানা ধরনের চাঁদা আদায় হয়৷ পরিবহণ থেকে মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামে চাঁদা আদায় হয়৷ ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ২৫ পয়েন্টে চাঁদা নেওয়া হয়৷ সায়েদাবাদ থেকে পটুয়াখালী ১৫ পয়েন্টে চাঁদা নেওয়া হয়৷ মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এক হাজার ২০০ গাড়ি চলাচল করে৷ তাদের ট্রিপ হয় দুইটা করে৷ প্রতি ট্রিপে ৮০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়৷ টিআইবি যে বছরে এক হাজার কেটি টাকা চাঁদা আদায়ের কথা বলেছেন বাস্ততে তার চেয়ে অনেক বেশি চাঁদা আদায় হয়৷”
“মালিক সমিতি বিআরটিএ থেকে নানা সুবিধা পায় তাই তারা টিআইবির রিপোর্টের বিরুদ্ধে বলছে৷ আর বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন, এই প্রতিবেদনে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে৷ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদাবাজি ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায়৷ তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে কেন? সাহস থাকলে তিনি তার সম্পদের তালিকা প্রকাশ করুক৷”
আর এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, “যেই অস্বীকার করুক না কেন পরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি হয়৷ এই খাতে চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়৷ বিশেষ করে পঁচনশীল দ্রব্যের ওপর চাঁদাবাজদের নজর বেশি৷ কারণ ওই পণ্য আটকে রাখলে বা দেরি করলে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েন৷”
মো. হেলাল উদ্দিন আরও জানান, “ট্রাকের ওজন স্কেলের নামে চাঁদাবাজি হয়, হাইওয়েতে ট্রাক আটকে সার্চ করার নামে চাঁদাবাজি হয়৷ এছাড়া পৌরসভা এলাকা পার হওয়ার সময়ও পণ্যবাহী ট্রাককে চাঁদা দিতে হয়৷ চাঁদাবাজি হলে পরিবহণ ভাড়া বেড়ে যায়৷ আর সেটা ব্যবসায়ীদেরই বহন করতে হয়৷”
“আমরা একবার সরেজমিন তদন্ত করে দেখেছি৷ তাতে শাকসবজিসহ কাঁচামালের ট্রাকই চাঁদাবাজির শিকার হয় বেশি৷” বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা৷
আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “পরিবহণ খাতে এই চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখার জন্য শাসক দলকে দরকার হয়৷ সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবহণ খাতেও শাসক দলের লোকজন নিয়ন্ত্রণ নেয়৷ চাঁদাবাজির জন্যই এটা হয়৷”
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে পরিবহণ ভাড়া পাশের দেশ ভারতের চেয়ে অনেক বেশি৷ সেবার মান অনেক খারাপ৷ পাবলিক যানবাহনও নিম্নমানের৷ এর কারণ চাঁদাবাজি৷ চাঁদাবাজির কারণে ভাড়া যেমন বেশি, তেমনি নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়৷ টিআইবি পরিবহণ খাতের চাঁদাবাজির আংশিক হিসাব দিয়েছে৷ তারা শুধু বাস মিনিবাসের কথা বলেছে৷ কিন্তু সড়কে সাত-আট ধরনের যানবাহন আছে৷ আমার হিসেবে এই খাতে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়৷ চাঁদাবাজির কারণে সড়ক পরিবহণে নৈরাজ্য চলছে৷ এর সঙ্গে বিআরটিএ, মালিক ও শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, পুলিশ জড়িত৷ এটাকে অস্বীকার না করে সরকারের উচিত আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া।”