আবারও একই মঞ্চে শামীম, সেলিম, আইভী
নারায়ণগঞ্জ শহরের অন্যতম নাগরিক সমস্যা যানজট ও হকার। এ নিয়ে আবারও একই মঞ্চে বসেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা, সেলিনা হায়াৎ আইভী, সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান ও এ কে এম সেলিম ওসমান। আজ সোমবার (৮ এপ্রিল) শহরের চাষাঢ়ায় বিকেএমইএ ভবন মিলনায়তনে একই মঞ্চে বসেন তাঁরা।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের উদ্যোগে এ মতবিনিময় ও ইফতার মাহফিলে বহুল আলোচিত হকার সমস্যা ছাড়াও ডিএনডি প্রজেক্ট নিয়েও আলোচনা হয়। উদ্ভুত সমস্যাগুলো নিরসনে ঈদুল ফিতরের পর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আয়োজনে আলোচনা সভা আয়োজনের কথাও উঠে আসে আলোচনায়।
হকার ইস্যুতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান জানান, তিনি মানুষের পেটে লাথি দিতে চান না।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী দাবি করেন, শামীম ওসমান চাইলেই হকাররা পালাবে।
মতবিনিময় সভার শুরুতে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান বলেন, ‘যানজটমুক্ত সুন্দর শহরের জন্য উদ্যোগ নেওয়ায় নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবকে ধন্যবাদ। আমরা চেষ্টা করেছি কাজ করার জন্য। হকারদের বসতে দেওয়ার জন্য জায়গা করে দিয়েছি। তাদের কাছে আমাদের একটাই দাবি ছিল, বঙ্গবন্ধু সড়কে তারা বসতে পারবে না। কিন্তু এর পরও তারা বসেছে, পুলিশ এসে সরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা চোর-পুলিশ খেলা চলেছে সেখানে। এলাকারই কিছু ছেলেপেলে তাদের বসিয়ে টাকা নিচ্ছিল। এটি একটি শিল্পাঞ্চল, বহিরাগত অনেক মানুষ এখানে। জেলাটিকে ঠিক করতে হবে। আমাদের মেয়র ঘোষণা দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু সড়কের দুই পাশ সবুজ করে দেওয়া হবে, যাতে দোকান বসলেও জনগণের অসুবিধা না হয়। অনেকেই প্রশ্ন করেন, নালিশ দেন, ধন্যবাদ জানান। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে সামনে বর্ষাকাল। হকারদের কোরবানির ঈদ পর্যন্ত বসতে দিতে হবে। যা-ই হয়েছে, আমরা ভুলে গেছি। এই কাজগুলো আসলে আমাদের আওতায় নয়, এটি সিটি করপোরেশন, পুলিশ প্রশাসনের কাজ। কিন্তু যতটুকু সহযোগিতা আমরা চেয়েছিলাম, ততটা আমরা পাইনি। আমাদের পুলিশের সংখ্যা কম। আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। আমরা কাজের চেষ্টা করেছি। ঈদের পরে আমরা আবার বসব। মেয়রকে অনুরোধ করছি, আপনি বসার ব্যবস্থা করুন।’
এরপর বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান বলেন, ‘মতবিনিময় করতে গেলে যাদের এখানে উপস্থিত থাকতে হবে, তারাই এখানে নেই। এখানে আলোচনার বিষয়টি বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের যানজট সমস্যা নিরসন। আমার কাছে তো মনে হয়, জেলায় যানজট ছাড়া আর কোনো সমস্যাই নেই৷ আমি স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড লোক। এখানে যানজটই একমাত্র সমস্যা, আর কোনো সমস্যাই নেই- এটা আমি মেনে নিব না। আরও অনেক সমস্যা আছে। আলোচনা হলে সব নিয়েই হওয়া উচিত। যানজট নিয়ে সিটি করপোরেশন তাদের প্রয়োজনীয় তাগিদপত্র জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারের কাছে দিতে পারেন। আমার বড় ভাই যানজট নিরসনে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা নিয়ে। আমার প্রশ্ন হলো, টাকা কেন দিতে হবে! সরকার তো টাকা দেয়। এটা তো এমপির দায়িত্ব না। আমি তখনও বলেছি, এখনও বলি—হকার বসলে সবখানে বসবে, না বসলে কোথাও বসবে না। আমি মানুষের পেটে লাথি দিতে চাই না। আমার মনে হয়, মধ্যিখান থেকে একটা পন্থা বের হবে। সেটি সিটি করপোরেশনেরই বের করা উচিত।’
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরে শামীম ওসমান বলেন, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক ১২০ ফিট চওড়া হচ্ছে। এ কে এম শামসুজ্জোহা সড়ক হচ্ছে, নাগিনা জোহা সড়ক হয়েছে। আমাদের ডিএনডি প্রজেক্ট জুন মাসে শেষ হবে। কিন্তু লোকাল ড্রেনেজগুলো কানেক্টেড করতে হবে ডিএনডির সঙ্গে, তা না হলে পানি সরতে পারবে না। এ ব্যাপারে মেয়রকে আমি লিখিতভাবে জানাব। আরেকটি সুখবর দিয়ে রাখি, নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের পাশে ২০০ কোটি টাকার একটি সম্পত্তি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি কাগজ জমা দিয়েছি এ বিষয়ে। সেখানে হার্ট ইনস্টিটিউট, ট্রমা সেন্টার, নিউরো সেন্টার যাতে হয়। সেইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ যাতে দ্রুত হয়—সেটিও বলেছি। আশা করি আল্লাহ আমাদের কবুল করবেন। এমনভাবে যেন কাজ করে যেতে পারি যাতে মৃত্যুর পরে মানুষ দোয়া করেন।’
বক্তব্যে জাতীয় সংসদের হুইপ ও নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান আমাদের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ভাই। সারা দেশে তাঁর সুনাম রয়েছে। অন্যদিকে একই পরিবারের সন্তান সেলিম ওসমান ভাই আমাদের অভিভাবক। আর আমাদের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী আপা নারী নেতৃত্বের আইডল। এখানে যারা একত্রিত হয়েছেন, তাদের আমরা সমর্থন জোগালেই নারায়ণগঞ্জবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব। তাদের কারণেই জেলায় এত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হচ্ছে।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে বক্তব্যে নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘হকার সমস্যা সারা দেশেই আছে। বিভিন্ন জায়গায় এটি সমাধানও হয়েছে, কিন্তু যারা এত বড় একটি জায়গা দেওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু সড়কে যাচ্ছে, তাতে আমাদের এক প্রকার ইনসাল্ট (অপমান) করা হচ্ছে। কে বা কারা করছে এটি, তা জানি না—কিন্তু এসব মেনে নেওয়া যায় না৷ এক নম্বর রেল গেইটের উপর বিশাল বড় মার্কেট হচ্ছে, যেটা রেলের প্রাক্তন কর্মচারীরা করছেন। আমরা এ বিষয়ে কেউ কিছু জানি না, বলছিও না। একটা শহরে যেখানে এতগুলো মানুষকে চেষ্টা করেও আমরা জায়গা দিতে পারছি না৷ এখানে সরকারিভাবে একটা মাল্টিফান্ডাল হাব হওয়ার কথা। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে এখানে একটি বড় বিল্ডিং হওয়ার কথা। এখানে রেলস্টেশনে, নৌসুবিধা ও বাস টার্মিনাল থাকার কথা।’
মন খুলে কথা বলতে না পারার আক্ষেপ জানিয়ে আইভী বলেন, আপনারা একই মঞ্চে ডাকছেন, আসছি, কথা বলছি, কিন্তু এর মানে তো এই না—এই শহরে যে যা খুশি তাই করবে। অনেক কাজই করতে পারি না, অনেক কথাই মন খুলে বলতে পারি না। চেষ্টা করছি সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে। তাতে কি অন্যান্য সংস্থা এসেও যা খুশি করবে, আমাদের অধিকার হরণ করবে আর স্থানীয় লোকজন চেয়ে চেয়ে দেখবে? জেলায় সমস্যা তো খুব বেশি দেখি না। যে দুয়েকটি সমস্যা আছে, সেগুলো যদি সেলিম ভাই ও শামীম ভাই বসে শুধু বলে দেয়, তাহলে তো তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান হয়ে যায়। শামীম ভাই আমাকে ফোন করছিল। আমি বলছি, ভাই আপনি যদি বলেন কালকে থেকে হকার বসবে না বঙ্গবন্ধু রোডে, তাহলে আর একজনও বসবে না৷ আপনি খালি এটা বলেন দাঁড়িয়ে। শামীম ভাই এটা বলবে না, কিন্তু বললে আসলেই থাকত না। ওরা কই পালিয়ে যাবে খুঁজেও পাবে না। সেলিম ভাই আমাকে বারবার বলেন মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য, আমি মোটেই মাথা গরম করছি না। আর সিদ্ধিরগঞ্জে লেক ও পানি সংরক্ষণ করছি বলেই নারায়ণগঞ্জ বেঁচে থাকবে। সেনাবাহিনী কাজ শেষ করলেই যেখানে যেখানে ড্রেন কানেক্টেড করা দরকার, সেগুলো আমরা করব।
আইভীর বক্তব্য শেষে শামীম ওসমান বলেন, ‘রাজনীতি করতে এসেছি সাধারণ গরিব মানুষের জন্য। মানুষের পেটে লাথি দিতে চাই না। জোর খাটিয়ে কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যদি আমি আশ্রয় দিতাম তাহলে তারা একজায়গায় বসত। আজকেও আমি তাদের ধমক দিয়ে এসেছি যেন তারা ওদিকে না যায়। আজকে আমরা যাদের ব্যাপারে কথা বলছি, তারাও কিন্তু মানুষ। কে দেশী আর কে বিদেশি—এসব কথা আমার ভালো লাগে না। নারায়ণগঞ্জে অন্য জেলা থেকে লাখ লাখ লোক এসে কাজ করছে। একটা বাচ্চা যখন তার বাবাকে খাবার দিতে পারেন না, তার কষ্টটা আমি ২০০১ সালের পরে বুঝেছি। তাই এই ধরনের কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বিল্লাল হোসেন রবিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু চন্দন শীল, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জীবন, বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ, নাসিকের কাউন্সিলর, বন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এহসান উদ্দিন, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ মহসীন মিয়া, ব্যবসায়ী নেতারাসহ অনেকেই।