সৌদিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত সরকারের
সৌদি আরবে অবস্থান করা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷ রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের এই সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক? এতে কি সংকট বাড়বে? রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কি এর কোনো প্রভাব পড়তে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সংকট বাড়তে পারে৷ সৌদি আরব চাপ দিয়ে বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলেছে৷ ২০১০ সাল থেকে তারা মূলত এই পাসপোর্ট নবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে৷
বাংলাদেশ কেন রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নে কালক্ষেপন করছে? বিষয়টি জানতে ঢাকা সফরে এসেছেন সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রী ড. নাসের বিন আবদুল আজিজ আল-দাউদের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল৷ গত রোববার (১২ মে) এই প্রতিনিধি দলটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে৷ ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দ্রুত নবায়নের জন্য চাপ দেওয়া হয়৷ একপর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়৷
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক সৌদি আরবে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন৷ তিনি বলেন, ‘৭৫ এর পরবর্তী সময়ে সৌদি সরকার বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আড়াই লাখ করে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তখন আমরা পাঠিয়েছিলাম৷ পাকিস্তানও পাঠিয়েছিল৷ আমরা যে ভুলটি করেছি, সেটা পাকিস্তান করেনি৷ পাকিস্তান কিন্তু তাদের জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্ট তৈরি করে৷ সেই ডকুমেন্টে তারা নামের পাশে ব্র্যাকেটে আর লিখে দেয়৷ অর্থাৎ পাকিস্তানি নাগরিক হলেও তারা রোহিঙ্গা৷ কিন্তু বাংলাদেশ সরাসরি তাদের পাসপোর্ট দিয়ে দেয়৷ এটা তখনকার প্রশাসনে যারা ছিলেন তাদের ভুল৷ মারাত্মক ভুল৷ তখন কিন্তু সৌদি আরব আমাদের বলেনি, তাদের পাসপোর্ট দিতে হবে৷ আমরাই আগ্রহী হয়ে তাদের পাসপোর্ট দিয়েছিলাম৷ সেটাই এখন আমাদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ যত দিন যাচ্ছে সংকট ততই বাড়ছে৷’
সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক
সৌদি স্বরাষ্ট্র উপমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বহু বছর আগে কিছু রোহিঙ্গা সৌদি আরব যায়৷ সঠিক সংখ্যাটি আমাদের অজানা৷ সৌদি পক্ষ আমাদের জানিয়েছে এই সংখ্যা ৬৯ হাজার৷ কিছু কম বেশি হতে পারে৷ সৌদি আরব প্রবাসী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না, তবে তাদের পাসপোর্ট নবায়ন করতে হবে৷ এই বিষয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে৷ রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের বিষয়ে আমরা কোথাও ধীরগতিতে এগোচ্ছি কি না, কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি কি না বা কোনো ফাঁকফোকর আছে কি না, তা দেখতে তিনি (সৌদি উপমন্ত্রী) এসেছেন৷ পাসপোর্টের তথ্য অপরিবর্তিত রেখে সেগুলো নবায়ন করা হবে৷’
সৌদি আরবে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার দায়িত্ব কেন বাংলাদেশ নেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সৌদি আবর কিন্তু ফেরত পাঠাবে না কাউকে৷ আবার সৌদি সরকার রোহিঙ্গাদের ওই দেশের নাগরিকত্ব দেবে না৷ তাহলে কীভাবে থাকবে? সেজন্য তাদের কিছু ডকুমেন্ট প্রয়োজন, সেজন্য তারা আমাদের অনুরোধ করেছিল৷ আমরা গত বছর সেটি স্বাক্ষর করেছিলাম৷’
সৌদিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা কি তাহলে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারা তো বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল৷ সুতরাং আমরা শুধু তাদের পাসপোর্ট রিনিউ করে দেব৷ তাদের নাম ঠিকানা পাসপোর্টে যেমন আছে, তেমন থাকবে৷’
২০১০ সাল থেকেই সৌদি আরব মূলত এই পাসপোর্ট নবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে৷ করোনার আগে তারা ৫৪ হাজার জনকে পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য বলেছিল৷ এখন তারা বলছে ৬৯ হাজার৷ মাঝে মধ্যেই এই সংখ্যা পরিবর্তন হচ্ছে৷
রোহিঙ্গাদের কেন বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিতে হবে?
জানা গেছে, ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে নির্যাতনের মুখে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছাড়তে বাধ্য হয়৷ তখন ওআইসির মধ্যস্থতায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে সৌদি আরব স্বেচ্ছায় আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দেয়৷ বাংলাদেশ আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেয়৷ কিন্তু পাকিস্তান আড়াই লাখ রোহিঙ্গার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়৷ সেখানে আবার তারা নামের পাশে আর লিখে দেয়৷ অর্থাৎ রোহিঙ্গা বিষয়টি উল্লেখ করে৷ সেই থেকে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসবেই চিহ্নিত করে৷ আর সংকটের শুরু সেখান থেকেই৷
অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘সৌদি আরব অনেকটা ইচ্ছে করেই বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলেছে৷ এই রোহিঙ্গারা তো সৌদি আরবের আগ্রহেই তখন গিয়েছিল৷ তারা কেন এদের পাসপোর্টের ওপর এত গুরুত্ব দিচ্ছে? রোহিঙ্গারা তো গণহত্যার শিকার৷ ফলে মানবাধিকারের জায়গা থেকেও তো তারা এদের আশ্রয় দিতে পারে৷ আবার মুসলিম উম্মার কথা বিবেচনায় নিলেও তো থাকতে দিতে পারে৷ তাহলে পাসপোর্ট এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? পাসপোর্ট ইস্যুর পর যদি তারা এদের ফেরত নিতে বলে তাহলে বাংলাদেশ তো তাদের ফেরত না নিয়ে পারবে না৷ কারণ এদের হাতে থাকবে বাংলাদেশের পাসপোর্ট৷ এখন আমাদের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক সেখানে আছেন, ফলে আমরা তাদের কথা ফেলতেও পারছি না৷ তারা ইচ্ছে করলেই আমাদের এই উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে পারত৷’
সতর্ক হতে হবে বাংলাদেশকে
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের জন্য উভয় সংকট৷ সৌদি আরবে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার৷ আবার সেখানকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিলে তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রশ্নও উঠতে পারে৷ দুটি বিষয় বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশকে সতর্কভাবে এগোতে হবে৷ আমাদের এখানে করাপশন আর অদক্ষতা আছে৷ ওই সময়ে যেসব রেহিঙ্গাকে সৌদি আরব নিয়েছে তাদের দীর্ঘকাল ধরে থাকার সুবিধা দিয়েছে৷ সেই সুবিধা পেয়ে বাংলাদেশিরাও রোহিঙ্গা হিসেবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব গেছে সুবিধা পাওয়ার জন্য৷ তাদের সংখ্যা হয়তো কম হবে৷ আবার রোহিঙ্গারাও এখানে অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব গেছেন৷ নাগরিকত্ব ছাড়াও পাসপোর্ট দেওয়া যায়৷ বাংলাদেশ তখন সেটা করতে পারত৷ পাকিস্তান সেটা করেছে৷ তবে সেজন্য সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের সেই ধরনের সমঝোতার দরকার ছিল৷’
মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘ওই সময়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার ব্যাপারটি ছিল সমঝোতামূলক৷ আর তার বিনিময়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানির দুয়ায় খুলে যায়৷ এখন তো আমাদের ২৮ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিক সৌদি আরবে কাজের সুযোগ পেয়েছে৷ সৌদি আরব যে তাদের পাসপোর্ট দিতে বলছে বা নবায়ন করতে বলছে সেটা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে৷ আমি লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত থাকার সময় দেখেছি সেখানে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অবস্থান করছে৷ পড়াশোনা করছে৷ ওই রোহিঙ্গারা সৌদি আরবে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন৷ এখন তারা পাসপোর্ট পেলে তাদের ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে৷ কিন্তু সমস্যা হলে সৌদি আরব বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের এককভাবে সবচেয়ে বড় উৎস৷ আবার বাংলাদেশি পাসপোর্টে যে রোহিঙ্গারা গেছে তারা, কিন্তু শত শত কোটি টাকার রেমিটেন্স পাঠায় মিয়ানমারে৷ আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না৷ তবে তাদের পাসপোর্ট দেওয়া হলেও প্রত্যাবাসনেও এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না৷’
অভিভাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির অবশ্য মনে করেন, সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি সেখানে কিন্তু রোহিঙ্গা শব্দটি উল্লেখ আছে৷ তিনি বলেন, ‘যেহেতু সব জায়গাতেই রোহিঙ্গা উল্লেখ করা হচ্ছে, ফলে বাংলাদেশের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই৷ সৌদি আরবের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে বাংলাদেশের এখন আর বিকল্প নেই৷ কারণ তারা অনেকদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের বিষয়ে কথা বলছে৷ এখন তারা বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বসহ নিয়েছে৷ ফলে এটা আর ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই৷ আমি মনে করি না, এই নবায়নের ফলে বাংলাদেশ কোনো সংকটে পড়তে পারে৷ আবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও এই পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি কোনো প্রভাব ফেলবে না৷’