ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফের সহায়তায় শিশুবিবাহ নিরসনে অঙ্গীকার
ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফের সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আজ বুধবার (৫ জুন) জয়েন্ট গ্লোবাল প্রোগ্রাম টু এন্ড চাইল্ড ম্যারিজ (জিপিইসিএম)-এর তৃতীয় পর্যায় উদ্বোধন করেছে।
এই কর্মসূচি চলবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। এখানে দেশজুড়ে সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা হবে। এর লক্ষ্য হবে বাল্যবিবাহ নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ ও দক্ষতা (রিসোর্স) বৃদ্ধি এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা প্রদান। কর্মসূচির নতুন এই ধাপে শিশুবিবাহবিরোধী আইন ও নীতিমালা জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে, শিশুদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার হ্রাস করার লক্ষ্যে কাজ করা হবে এবং সরকারের সামাজিক সুরক্ষার স্কিমগুলো আরও কার্যকর করা ও কমিউনিটিরর সঙ্গে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক রীতি-নীতি পরিবর্তনে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫ নম্বর লক্ষ্য, যেখানে ২০৩০ সাল নাগাদ শিশুবিবাহ নিরসনের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই এ সংক্রান্ত প্রচেষ্টা ২২ গুণ বাড়াতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, অনেক জেলায় বাল্যবিবাহ কমে আসার প্রবণতা দেখা গেলেও অন্যান্য জায়গায় তা বাড়ছে, যার শিকার হচ্ছে সবচেয়ে অসহায় জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। সম্পদশালী পরিবারের শিক্ষিত কন্যাশিশুদের মধ্যে শিশুবিবাহের হার কমে আসছে। অপরদিকে সুবিধাবঞ্চিত, অশিক্ষিত ও গ্রামীণ কন্যাশিশুদের মধ্যে শিশুবিবাহের প্রচলন এখনো উচ্চ হারে রয়ে গেছে।
জিপিইসিএম-এর তৃতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী এই অনুষ্ঠানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন (রিমি) বলেন, “বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার রক্ষায় আমাদের যে অঙ্গীকার, তার মূলে রয়েছে শিশুবিবাহ নিরসন। আমরা ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফের সমন্বিত প্রচেষ্টার ভূমিকা স্বীকার করি এবং শিশুবিবাহ নিরসনে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও শিশুবিবাহ নিরোধ আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতে ঘনিষ্ঠ ও কার্যকরভাবে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছি। শুধু আইনের মাধ্যমে শিশুবিবাহ নিরসন করা যাবে না। সে কারণে এ বিষয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তনে কাজ করার ওপরেও আমরা গুরুত্ব দেব।”
প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সাল নাগাদ ১৮ বছরের কম বয়সী কন্যাশিশুদের বিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছেন। এই প্রচেষ্টায় সরকারকে সহায়তার জন্য গ্লোবাল প্রোগ্রামে শিশুবিবাহ নিরসনে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনার পুরো মাত্রায় বাস্তবায়ন নিশ্চিতের জন্য কাজ করা হবে। সে লক্ষ্যে অনেক খাতের সম্মিলন ঘটিয়ে পরিবর্তন আনতে সক্ষম এবং তথ্য-উপাত্তভিত্তিক নানা পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বাংলাদেশে ইউএনেফপিএর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্রিস্টিন ব্লখুস বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর মাত্র ২ দশমিক ১ শতাংশ হারে শিশুবিবাহ কমছে। এর অর্থ দাঁড়ায় বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিরসনের জন্য দুই শতকের বেশি সময়- ২১৫ বছর লেগে যাবে। কন্যাশিশুদের স্কুলে পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে পারলে তা বেশ কাজে দেবে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় বর্ধিত ও সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ এবং কম্প্রিহেন্সিভ সেক্সুয়ালিটি এডুকেশন কিশোরীদের তাদের শরীর ও জীবন সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করে তুলবে, যা তাদের পরিবর্তনের দূত ও ভবিষ্যৎ নেতা হয়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দেবে।”
বাংলাদেশে ইউনিসেফের ওআইসি রিপ্রেজেন্টেটিভ স্ট্যানলি গুয়্যাভুয়া বলেন, “ইউনিসেফ আবারও প্রতিটি শিশুর ক্ষমতায়ন, বিশেষ করে গ্রামীণ কিশোরী ও অল্প বয়সী নারীদের জীবনদক্ষতা তৈরিতে কাজ করার অঙ্গীকার নিয়েই কর্মসূচির নতুন এই পর্যায় শুরু করছে। যেসব জেলায় উচ্চ মাত্রায় শিশুবিবাহ রয়েছে, সে সব জায়গায় আমরা অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে শিশুবিবাহের মূল কারণ মোকাবিলার পাশাপাশি এক্ষত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন এমন সবাইকে যুক্ত করব। সেই সঙ্গে আমরা বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরী কন্যাশিশুদের সমন্বিত সহায়তা প্রদান করব।”
কর্মসূচির আগের পর্যায়গুলোতে ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফ যৌথভাবে সরকারকে সহায়তা দিয়ে এসেছে। যাতে ৫৫ লাখ শিশুর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এই পর্যায়গুলোতে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের কারণ উদঘাটন, তৃণমূলের সংগঠনগুলোর ক্ষমতায়ন, দৃশ্যমান সেবাসমূহ আরও জোরদার করা এবং অসহায় কন্যাশিশুদের সুরক্ষার জন্য কাজ করার ক্ষেত্রেও ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দিয়ে এসেছে।
ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফ আগামী চার বছরে (২০২৪-২০২৭) বাংলাদেশে শিশুবিবাহ নিরসনের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে চায়। সেজন্য তারা যৌথ কর্মপরিকল্পনার আওতায় ১২ লাখের বেশি কিশোরীকে (১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী) জীবনদক্ষতার প্রশিক্ষণ এবং লিঙ্গ ও যৌন আচরণ ও শিক্ষা সম্বলিত সুষ্ঠু জ্ঞান তথা ‘কম্প্রিহেন্সিভ সেক্সুয়ালিটি এডুকেশন (সিএসই)’ এর আওতায় আনা হবে।
ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ ও অন্যান্য অংশীজনদের যৌথ প্রচেষ্টাসমূহ, বাংলাদেশে প্রতিটি কন্যাশিশু ও ছেলে যেন শিশুবিবাহের ঝুঁকি ছাড়াই তাদের শৈশব উপভোগ এবং নিজেদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে তা নিশ্চিতে যে সম্মিলিত অঙ্গীকার রয়েছে সেটাকেই প্রতিফলিত করে। বিশেষ করে এই উদ্যোগে বাল্যবিবাহের মূল কারণসমূহ যেমন দারিদ্র্য, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার, জলবায়ুজনিত অভিঘাত ও জরুরি মানবিক পরিস্থিতি-এসব বিষয় মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
২০১৬ সালে শুরু হওয়া ইউএনএফপিএ-ইউনিসেফ গ্লোবাল প্রোগ্রাম টু এন্ড চাইল্ড ম্যারিজ হল বাল্যবিবাহ নিরসনে নেওয়া সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক উদ্যোগ। এই উদ্যোগে বেলাজিয়াম, কানাডা, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে ও যুক্তরাজ্যের সরকার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জোন্টা ইন্টারন্যাশনাল সহযোগিতা করছে।