ড. ইউনূসের নেতৃত্বে কি ‘অন্ধকার যুগের’ সমাপ্তি ঘটবে : আল-জাজিরা
শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে প্রবল আন্দোলনের মুখে দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মালিহা নামলাহ সোমবার (৫ আগস্ট) থেকে অস্থিরতা আর উদ্বেগে সময় পার করছিলেন।
সপ্তাহজুড়ে প্রাণঘাতী সহিংসতায় তিন শতাধিক মানুষের জীবনহানির পর ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেলেন, তখন থেকেই মালিহার উদ্বেগ বাড়ছিল কীভাবে একটি নতুন সরকার সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের স্থলাভিষিক্ত হবে। তার উদ্বেগ ছিল, নতুন করে আবার সামরিক শাসন চলে আসে কিনা, কেননা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে সেনা শাসনের বেশকিছু নজির রয়েছে বাংলাদেশে।
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অশান্ত ও টালমাটাল পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে ঘোষণা দেন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে।
গতকাল শুক্রবার (৯ আগস্ট) মালিহা কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেন, ‘সামরিক সরকার গঠনের জন্য আমরা লড়াই করিনি, রক্ত দেইনি। আমরা একটি বেসামরিক সরকার চাই, যা সত্যিকারের সংস্কার নিয়ে আসবে। আর আমরা চিন্তামুক্ত হয়েছি, সেই প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুতই শুরু হয়েছে।’
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে শান্তি ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘প্রধান উপদেষ্টা’ হিসেবে শপথ নেন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার পদটি প্রধানমন্ত্রী পদের সমকক্ষ এবং অন্যান্য উপদেষ্টারা মন্ত্রী পদের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের কথা অনুয়ায়ী ১৫ বছরের ‘অন্ধকার যুগ’ থেকে ১৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটি বের হয়ে আসেত পারবে কিনা, সেটিই এখন অনেকে ভাবছেন।
টেলিভিশনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখার পর সাইফুল্লাহ সজীব নামের একজন ট্রাভেল এজেন্সির কর্মী রাজধানী ঢাকায় আলজাজিরাকে বলেন, ‘সেনাপ্রধান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের। তবে, যতক্ষণ না আনুষ্ঠানিকভাবে সেই সরকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, ততক্ষণ এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছিল, অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছিল।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন বেছে নেওয়া হলো
গত মাসে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রতিবাদে আন্দোলনের সূচনা হয় ১০ হাজারেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে। তাদের অভিযোগ এই কোটা ব্যবস্থার সুবিধা শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের লোকজনকে দেওয়ার জন্যই ব্যবহার করা হচ্ছিল।
শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আক্রান্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মাধ্যমে। সহিংস আক্রমণে তিন শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হওয়ার পর সেই আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ডাক দেওয়া হয়।
আন্দোলনের মুখে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যাবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ৮৪ বছর বয়সী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস হলেন একজন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ, যিনি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। বাংলাদেশের লাখ লাখ গরিব নাগরিককে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বের করে আনতে তাঁর নেওয়া প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে এ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। দীর্ঘদিন থেকে শেখ হাসিনার সরকারের সমালোচনা করে আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সরকার পতনের দিনটিকে ‘দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এ বিষয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন নামে বাংলাদেশের একজন গার্মেন্টস শিল্প ব্যবসায়ী আলজাজিরাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শপথ নিতে দেখে আমি নিজেকে ভারমুক্ত মনে করছি।’ তিনি আরেও বলেন, ‘সংকটের এই মুহূর্তে তাঁর মতো যোগ্যতাসম্পন্ন লোকই দেশকে পথ দেখানে পারবে বলে আমি আশা করছি।’
প্রতিটি ঘরে স্বাধীনতা পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি
গত বৃহস্পতিবার শপথ নেওয়ার পর উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থী নেতাদের উপস্থিতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি পরিবার। আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। এই দেশের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হলো সবাই যেন স্বাধীনতার মুক্ত বাতাস উপভোগ করতে পারে।’
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘আমাদের নিশ্চিত করতে হবে স্বাধীনতার এই সুবিধা যেন দেশের প্রতিটি নাগরিদের কাছে পৌঁছায়। অন্যথায়, তা হবে অর্থহীন। আর এ জন্য আমরা প্রতিটি ঘরে স্বাধীনতা পৌঁছে দিতে প্রুতিশ্রুতিবদ্ধ।’ একইসঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের সময় যারা অন্যায় করেছে, তাদের দায়বদ্ধতার আওতায় আনার কথাও বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা। কেননা, সরকার পরিবর্তনের এই সময়টিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের ওপর হামলা চালানো হয়, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মন্দির ও সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের লোক হামলার শিকার হয়। এ অবস্থায় পুলিশের অনুপস্থিতিতে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
কে কে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারে
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে অভিজ্ঞ ও তরুণদের সংমিশ্রণ ঘটেছে, যাতে রয়েছেন অধিকারকর্মী, অধ্যাপক, আইনজীবী, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের লোকজন। চমক হিসেবে আছে ২৬ বছর বয়সী দুজন উপদেষ্টা, যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সামনের চ্যালেঞ্জ
শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে অভিযোগটি ছিল, তা হলো নিরাপত্তা বাহিনীকে বিশেষ করে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীকে অপব্যবহার করা। তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে নির্বাচনি ব্যবস্থায় সেগুলোকে ব্যবহার করার পাশাপাশি বিরোধী দল ও মতকে দমনেও ব্যবহার করা হয়েছিল তাদের।
অন্যদিকে, সহিংসতা চলার সময় বেশকিছু পুলিশ সদস্য জনতার হামলায় নিহত হওয়ার ফলেই বোঝা যায় তারা কতটা ক্ষুব্ধ এই বাহিনীটির প্রতি। শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশ বাহিনীর অনুপস্থিতিতে ছাত্র-জনতা একতাবদ্ধ হয়ে এখন রাস্তায় টহল দিচ্ছে, প্রতিবেশী ও সংখ্যালঘুদের বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের নিরাপত্তা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে।
পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাধারণ কথায় ‘শক্তিশালী ও দুর্বল’ দুটোই হয়ে থাকে। তিনি আশা করেন, প্রয়োজন অনুসারে উপদেষ্টা পরিষদে আরও লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। দুজন তরুণকে উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন তিনি।
অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতে, সরকারের সামনে এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি। তাৎক্ষণিক যে চ্যালেঞ্জ সেটি হলো ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিষ্কার দিক নির্দেশনা প্রদানের বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করা। দ্বিতীয় যে চ্যালেঞ্জটির কথা তিনি বলেছেন, তা হলো দেশের অর্থনীতি প্রসঙ্গে। তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষকে সাহায্য করবে এমন কিছু পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হবে, যাতে জনগণ মনে করে এই সরকার আগের সরকারের চেয়ে আলাদা। তবে যাই হোক না কেন এই সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো যত দ্রুত সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা।