গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ
গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। আজ বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই সনদে স্বাক্ষর করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।’
আগামীকাল ৩০ আগস্ট গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসের আগেই এই সনদে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস ইউং গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে সরকার ইতোমধ্যে হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে ইতোমধ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি গঠন করে ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ সালের ক্ষমতাবলে এই কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্ট গার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের’ জন্য এ কমিশন।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের অভিযোগ নিয়ে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের সমালোচনা রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ‘আয়নাঘর’ হিসেবে পরিচিত গোপন বন্দিশালা থেকে দীর্ঘ সময় পর বেশ কয়েকজন ব্যক্তি মুক্ত হওয়ার পর গুমের বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সাতশর বেশি মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৫০ জনের বেশি মানুষের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ৯টি সনদের আটটিতে সই করেছে। জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের অনুরোধের পরও বিগত সরকার গুমবিরোধী সনদে সই করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার সমুন্নত রাখার পাশাপাশি গুমের সংস্কৃতি বন্ধ করতে চায়। এ লক্ষ্যে সরকার গুমবিরোধী সনদে যুক্ত হতে যাচ্ছে।
ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিটি গুমের তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে দেশবাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। গত সোমবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সরকারি বাহিনীর যে সদস্যরা ‘গুম, খুন, নির্যাতনের’ মত অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী সরকারের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, অপহরণ এবং আয়নাঘরের মতো চরম ঘৃণ্য সকল অপকর্মের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত সকলের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তালিকা প্রস্তুত করে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের বিচার করা হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পরদিন গঠিত কমিশনের কার্যপরিধিতে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট পর্যন্ত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, তাদের শনাক্ত এবং কোন পরিস্থিতিতে গুম হয়েছে, তা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনাসমূহের বিবরণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করা এবং এতদ্বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করা; জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান পাওয়া গেলে তাহাদের আত্মীয়-স্বজনকে অবহিত করা এবং জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত তদন্তের তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে এই কমিশন।’
গুমবিরোধী সনদটি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এটি অনুস্বাক্ষর করার পরে ২০১০ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। সামগ্রিকভাবে এই সনদের লক্ষ্য গুম বন্ধের পাশাপাশি এই অপরাধের জন্য দায়মুক্তি বন্ধ করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।