ভ্যানে ওঠানো নিথর দেহগুলো পুড়িয়ে ফেলেছিল পুলিশ, দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের
ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট। গণবিপ্লবের মুখে ততক্ষণে হেলিকপ্টারে করে ভারতের দিকে উড়াল দিয়েছেন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। সেই সংবাদে দেশে তখন উচ্ছ্বাস। আর ঠিক তখনই একটি থানা প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। থানা ঘেরাও করা ছাত্র-জনতার ওপর বৃষ্টির মতো চালানো হয় গুলি। এক সময় জনতা সরে গেলে একে একে ভ্যানের ওপর স্তুপ করা হয় নিথর দেহ। স্তুপ করা দেহের সেই ভিডিও গতকাল শুক্রবার (৩১ আগস্ট) ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এরপর অনুসন্ধ্যানে নামে এনটিভি অনলাইন। জানা যায়, এই ঘটনা আশুলিয়া থানার।
প্রত্যক্ষদর্শীরা সেদিনের নারকীয় অধ্যায়ের বর্ণনা দেন। তাদের দাবি, ভ্যান থেকে নিথর দেহগুলো থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের অন্য একটি পিকআপ ভ্যানে তোলা হয়। এরপর সেই ভ্যানে লাগিয়ে দেওয়া হয় আগুন। নিথর দেহগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে যায়। সেদিন থাকা ঢাকা জেলা (উত্তর) গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (তদন্ত) আরাফাত হোসেন, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল, এসআই মালেক এই গণহত্যা চালান।
প্রত্যক্ষদর্শী নাজমা বেগম এসব তথ্য জানানোর পাশাপাশি জানান, থানা সংলগ্ন ইসলাম পলিমারস অ্যান্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার্স ফ্যামিলি কোয়াটারের সামনে পড়েছিল গুলিবিদ্ধরা। সেখান থেকে ভ্যানে নিয়ে পরে থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের অন্য একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয় পুলিশ সদস্যরা। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ দিনে কতবার যে এমন দৃশ্যের কথা মনে করে ঘুম ভেঙে গেছে তা বলতে পারব না। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’
পুড়িয়ে দেওয়া হতভাগ্যদের মধ্যে ছিলেন, আশুলিয়ায় বৈষম্যবিরোধ ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া স্কুলছাত্র আস-সাবুর (১৬)। তাকেও ওই স্তুপে তোলা হয়। নিহতের বড়ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, ‘গুলিতে আমার ভাইটা লুটিয়ে পড়ল। দূর থেকে অসহায়ের মতো দেখলাম, পুলিশ ওকে রাস্তা থেকে তুলে ভ্যানে স্তুপ করা অন্য লাশের ওপর ফেলল। তারপর পিকআপ ভ্যানে স্থানান্তর করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল, তখনও জীবিত মারা যায়নি। আদরের ছোট ভাইটাকে মনে হয় জীবন্তই পুড়িয়ে মারল।’
অপর প্রত্যক্ষদর্শী মোবারক হোসেন জানান, মনে হচ্ছিল, পুলিশ উন্মাদ হয়ে গেছে। যাকে সামনে পাচ্ছে, তাকেই গুলি করছে। চোখের সামনে দেখলাম পাখির মত মানুষ মারতে। বেশ কিছুক্ষণ পর বীভৎস গন্ধ টের পেলাম। পরিস্থিতি শান্ত হবার পর কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, অনেকগুলো পোড়া লাশের স্তুপ। থানা ছেড়ে পালিয়েছে পুলিশও।
এমন ঘটনা যে থানার, সেই থানার দায়িত্বে তখন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ। সম্প্রতি তাকে বদলি করা হয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে। সেদিনের ঘটনার সম্পর্কে এ এফ এম সায়েদ বলেন, আমার পরিবার ছিল থানার ওপরে কোয়ার্টারে। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই আমি আমার পরিবারকে পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যেতে বলি। পরিস্থিতি এমন ছিল যে আত্মরক্ষার জন্য গুলি করা ছাড়া আমাদের সামনে আর বিকল্প কিছু ছিল না। তবে, আমরা যেটাই করেছি, সেটা ওপরের নির্দেশেই করেছি। এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে আপনারা কাফী স্যারকে করেন।
জানা গেল এই কাফী মানে ইউনিট কমান্ডার হিসেবে সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্ ও ট্রাফিক, উত্তর বিভাগ) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভাই, আমি সেদিন সাভারেই যাইনি, কীভাবে অর্ডার দেব?
২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর কাফী যোগ দেন ঢাকা জেলা পুলিশে। সূত্রমতে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ২৯ বিসিএসের (পুলিশ) এই কর্মকর্তা। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথিত ছেলে হিসেবেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে সমীহ করে চলতেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গতিপথ নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করে নানা সূত্রে আব্দুল্লাহিল কাফী টের পেয়েছিলেন সরকারের পতন সময়ের অপেক্ষামাত্র। ওসি এ এফ এম সায়েদের দাবি, কাফীই প্রতিটি মুহূর্তে ওয়ারলেসে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আব্দুল্লাহিল কাফী বলেন, ওদিন আমি সাভারে যাইনি। আমার হাতে ওয়ারলেসও ছিল না। আমি কীভাবে নির্দেশ দিলাম? অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘একটু বেলা করেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। গাবতলীর কাছে পৌঁছে পরিস্থিতির বেগতিক দেখে নিরাপদে চলে গিয়েছিলাম।’
কাফীর এমন সব উত্তরে আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদের কাছে আবারও জানতে চাওয়া হয় ঘটনা সম্পর্কে। তিনি বলেন, এটা মিথ্যা কথা। স্যার আমাদের নিজে ওয়ারলেসে নানা সময় নানা নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তো ভেবেছি, স্যার সাভারে বসে আমাদের এসব নির্দেশনা দিচ্ছেন।
একইকথা বলেছেন, ঢাকা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ (বিপ্লব)। তিনি বলেন, আমরা তো কাফী স্যারের কমান্ডেই চলেছি। উনি তো সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে ওয়ারলেস যুক্ত ছিলেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সাভারে দেখা যায়নি আব্দুল্লাহিল কাফীকে। সম্প্রতি ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামানকে বদলি করা হয় সারদা পুলিশ একাডেমিতে। তার স্থলে যোগ দেন পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ।
গত ২৯ আগস্ট সকালে ঢাকা জেলা পুলিশের নবাগত পুলিশ সুপার যোগদান উপলক্ষে বিশেষ কল্যাণ ও মতবিনিময় সভায় পুলিশ সুপারদের পাশেই দেখা উদয়া হন শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিন হত্যা মামলার আসামি এই আব্দুল্লাহিল কাফী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৮ জুলাই সাভারে পুলিশের গুলিতে প্রথম নিহত হন মিরপুরের মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী ইয়ামিন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ আগস্ট ইয়ামিনের মামা আব্দুল্লাহ আল কাবির ঢাকার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুল ইসলামের আদালতে হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। ওই মামলায় কাফীসহ ৪৯ জনকে আসামি করা হয়। এ বিষয়েও পুলিশ সদর দপ্তর নিবিড় অনুসন্ধান করছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।