পাবনায় টুকুপুত্রের ‘বালু সম্রাজ্য’ এখন বেওয়ারিশ!
পাবনার বেড়া পৌর এলাকার পায়না মহল্লায় হুরাসাগর নদের পাড়ে পড়ে রয়েছে প্রায় ৩০টি বালু উত্তোলনের ড্রেজার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন (৫ আগস্ট) থেকে ৩৩ দিন ধরে সেগুলো ‘বেওয়ারিশ’ অবস্থায় সেখানে পড়ে আছে।
অথচ সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত ড্রেজারগুলো দিয়ে দিনরাত যমুনা ও হুরাসাগর নদ থেকে বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ছেলে আসিফ শামস্ রঞ্জনের নেতৃত্বে বালু তোলা হতো।
স্থানীয়রা জানায়, প্রকাশ্যে ড্রেজার লাগিয়ে অবৈধভাবে বালু তোলা হয় যমুনা নদীর পেঁচাকোলা থেকে শুরু করে হুরাসাগর নদের পাঁচ-ছয়টি পয়েন্টে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ যমুনাপাড়ের বিভিন্ন গ্রাম ভাঙনের ঝুঁকিতে ফেলে এভাবে কোটি কোটি টাকার বালু তোলা হলেও কাগজ-কলমে ওই এলাকায় কোনো বালু মহালই নেই। বরং ভাঙন ঝুঁকির কারণে বালু তোলা নিষিদ্ধ।
কয়েক বছর ধরে একক নিয়ন্ত্রণে এই বালু উত্তোলনের নেতৃত্ব দিতেন শামসুল হক টুকুর ছেলে বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আসিফ শামস রঞ্জন। ফলে সব জেনেও না দেখার ভান করত প্রশাসন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আসিফ আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে অবৈধ বালু উত্তোলন।
এলাকাবাসী জানায়, টুকু পরিবার গত ১৬ বছরে অবৈধভাবে বালু তুলে অন্তত ২০০ কোটি টাকা আয় করেছে। এখন ক্ষমতার পালা বদলে লোভনীয় এই বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্রিয় কয়েকটি চক্র। আপাতত বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি এই বালির সম্রাজ্য দখলে মরিয়া বিভিন্ন গ্রুপের বিরোধে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সংঘর্ষের আশঙ্কায় সেনাবাহিনীর নজরদারি রয়েছে সেখানে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া এই বালু তোলা বন্ধ করা অসম্ভব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালের পর বিভিন্ন এলাকার শামসুল হক টুকুর অনুসারীরা বালু তুলে বিক্রি করত। ২০২১ সালের প্রথম দিকে আসিফ শামস বালু উত্তোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হন। পরে ওই বছরেরই নভেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিতর্কিত নির্বাচনে বেড়া পৌরসভার মেয়র হয়ে বালু উত্তোলন একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এরপর ছোট ড্রেজারের পাশাপাশি ভাড়া করে আনা কয়েকটি ভারি ড্রেজারের মাধ্যমে বালু তোলা শুরু করেন।
অভিযোগ রয়েছে, আসিফ শামস ডেপুটি স্পিকারের প্রভাব খাটানোয় প্রশাসন বালু তোলায় বাধা দেয়নি। সরকারকে রাজস্ব দিতে হতো না বলে পুরো আয়ই যেত আসিফ শামস রঞ্জনের পকেটে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে যমুনা পাড়ের নেওলাইপাড়া, নতুন বাটিয়াখড়া, চরনাগদাহ, হাটাইল-আড়ালিয়া, চরসাঁড়াসিয়া গ্রামসহ সাতটি গ্রামে নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া পাউবোর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধও পড়েছে চরম ঝুঁকির মধ্যে।
পায়না মহল্লার মো. রাতুল ও কালু শেখ নামের দুজন ড্রেজার শ্রমিক এনটিভি অনলাইনকে জানান, পায়নাসহ কয়েকটি মহল্লার প্রায় ৭০০ মানুষ বালু তোলার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া রয়েছেন বালুবাহী ট্রাকে কাজ করা কয়েকশ শ্রমিক। বালু তোলা বন্ধ থাকায় তারা এখন বেকার।
বেড়া পৌরসভার পায়না মহল্লার বাসিন্দা ও সাবেক কাউন্সিলর এনামুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “বাবার প্রভাব খাটিয়ে আসিফ শামস অবৈধভাবে বালু তুলে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। অনেক কৃষকের ফসলি জমি থেকেও জোড় করে বালু তুলে কৃষিজমি নষ্ট করেছেন। আদালতে মামলাও হয়েছে। তবু তিনি থামেননি। তিনি আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় স্পষ্টতই এই ‘বালু সম্রাজ্য’ এখন তার হাতছাড়া। কয়েকটি চক্র সুযোগ বুঝে তা দখল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।”
এ ব্যাপারে পাউবোর বেড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হুরাসাগর ও যমুনার নিষিদ্ধ পয়েন্টে বালু উত্তোলন বিপজ্জনক। নদী ভাঙনের পাশাপাশি বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর হওয়া প্রয়োজন।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বেড়া উপজেলায় কোনো বালু মহাল নেই। ‘হুরাসাগর নদ ও যমুনা নদীর কিছু স্থানে সেনাবাহিনী ও বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং করছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বালু তোলার সুযোগ নেই। অবৈধভাবে কাউকে বালু তুলতে দেওয়া হবে না।’