বাংলাদেশ নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র-হুমকি বরদাশত করা হবে না : ১২ দলীয় জোট
বাংলাদেশ নিয়ে কোনোরকম ষড়যন্ত্র ও হুমকি বরদাশত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যে ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন, সেজন্য ক্ষমা চাইতে হবে বলেও মন্তব্য করেন জোটটির নেতারা।
আজ মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ১২ দলীয় জোটের উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের আগ্রাসী হুমকির প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশে নেতারা এসব কথা বলেন। সমাবেশ শেষে প্রেসক্লাব চত্বরে একটি মিছিল বের করেন নেতারা।
১২ দলীয় জোটের নেতারা বলেন, ‘ভারতের আগ্রাসীনীতির ফলে প্রতিবেশী সবগুলো দেশের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তান-নেপাল-শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ-আফগানিস্তান কেউই ভারতকে বিশ্বাস করে না। সবাই এখন ভারতের অবিবেচক ও নেতিবাচক আচরণে অতিষ্ঠ।’
জোটটির নেতারা বলেন, ‘ভারতের পুতুল শেখ হাসিনা সরকারের কারণে বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাংলাদেশের জনগণ ভারতের উৎপীড়নে ক্ষুব্ধ ছিল। খুনি হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ভারত আরও দৃঢ়ভাবে বৈরী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ভারতের আগ্রাসী মনোভাব ও কর্তৃত্বশীল আচরণকে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই মেনে নেবে না।’
১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন ১২ দলীয় জোট প্রধান ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। এতে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক হুইপ জয়নুল আবদীন ফারুক।
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের মহাসচিব শাহ আহমেদ বাদল, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন পারভেজ, ইসলামী ঐক্য জোটের সিনিয়র সহসভাপতি শওকত আমীন, ইসলামিক পার্টির মহাসচিব আবুল কাশেম, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির (পিএনপি) চেয়ারম্যান ফিরোজ মো. লিটন ও নয়া গণতান্ত্রিক পার্টির সভাপতি মাস্টার এম এ মান্নান। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ এলডিপির অতিরিক্ত মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটু।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকার আওয়ামী লীগের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে নতুন শক্তভাবে পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে। তাদেরকে ধন্যবাদ। ভারতের কাছ থেকে অবন্ধুসুলভ আচরণ মানতে পারি না। আমরা তাদেরকে বন্ধু ভেবে থাকি। বাংলাদেশের চারদিকে অশান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আসাম, মনিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে। ভারত যদি তার নীতি সংশোধন না করে তাহলে আল্লাহ জানেন তাদের ভাগ্যে কী হবে? ইতোমধ্যে ভারতের ৬০ মাইল এলাকা বিদেশি দেশের দখলে চলে গেছে। আমরা বাংলাদেশে শান্তি চাই। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অটুট রেখে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখে দেশ পরিচালনা করতে চাই। ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানানো এবং বাংলাদেশের বিতারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়া।’
প্রধান বক্তা বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নানারকম সংকটে পড়েছে। তবুও সেখানকার মানুষ বলে এখনও কেন শেখ হাসিনার বিচার হচ্ছে না। এই একমাস পাঁচ দিনে শেখ পরিবারের কাউকে বিচারের আওতায় আনলে মানুষ বিশ্বাস করত। আমরা আপনাকে বিশ্বাস করি। জনগণ বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা প্রশ্ন তুলছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বলব অপরাধীরা কোথায়?’
জয়নুল আবদীন ফারুক আরও বলেন, ‘ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলব, ‘আপনারা মন্ত্রী আমিও কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেজন্য আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মন বড়। তারা ক্ষমা করতে জানে। সুতরাং, বাংলাদেশ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেবে না, সেটা কেউ মেনে নেবে না।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে বিএনপিনেতা জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, ‘আপনারা একটা নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নিন। আজকে দেশবাসী সবাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকি। আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মারা যাতে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করতে না পারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে আগামীতে বাংলাদেশ পরিচালিত হবে, ইনশাআল্লাহ।’
এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যেভাবে চোখ রাঙিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমরা সহ্য করব না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আহ্বান অবিলম্বে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ব্যাখ্যা নেন। আমরা কিন্তু সহ্য করব না। আমাদের চোখ রাঙানি দেখিয়ে লাভ নেই।’
শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘বিএনপি আগামীতে আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব, আপনারা আরও কঠোর হোন এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করুন।’
সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা আমরা বরদাশত করব না। ভারতের আগ্রাসনের দিন শেষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। সুতরাং, বাংলাদেশের দিকে নজর না দিয়ে নিজের ঘর সামলান। মনিপুরে কিন্তু সাত রংয়ের পতাকা উড্ডয়ন হয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশ নিয়ে সাবধান।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে এহসানুল হুদা খুনি, দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফার ভিত্তিতে আগামীতে বাংলাদেশ সংস্কার হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মুহিউদ্দিন ইকরাম বলেন, ‘মনিপুর কিন্তু ইতোমধ্যে ভারতের পতাকা ছিঁড়ে ফেলেছে। তারা নিজেদের পতাকা উড্ডীন রেখেছে। সুতরাং, ভারতকে বলব, আগে নিজেদের ঘর সামলান। বাংলাদেশ নিয়ে কোনো চক্রান্ত মেনে নেওয়া হবে না। এটা ওলি-আউলিয়াদের দেশ। এটা সম্প্রীতির দেশ।’
মুহিউদ্দিন ইকরাম আরও বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছেন, সেটা বাস্তবায়ন করুন। আমরা সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ চাই না। অবিলম্বে আপনারা রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।’
লায়ন ফারুক বলেন, ‘স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিদায় হয়েছে তবে তাদের দোসররা ষড়যন্ত্র অবঅব্যাহত রেখেছে। তারা বিভিন্নভাবে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তাদের স্বপ্নপূরণ হবে না। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করার। বিএনপি সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে যে ৩১ দফা রুপরেখা ঘোষণা করেছে, সেই মোতাবেক রাষ্ট্র সংস্কার করতে হবে। না হলে শেখ হাসিনার মতোই বাংলাদেশ রয়ে যাবে।’
অন্য বক্তারা বলেন, দেশের মালিক জনগণ অথচ ভারত বরাবরই জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ছলে-বলে-কৌশলে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত শেখ হাসিনার অবৈধ সরকারকে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কবর দিতে দ্বিধা করেনি।
নেতারা আরও বলেন, ‘ভারতকে আগ্রাসী নীতি ও ভূমিকা ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি ন্যায়সঙ্গত ও বন্ধুসুলভ আচরণে অভ্যস্ত হতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের আস্থা লাভ করতে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হবে, ৫৪টি অভিন্ন নদীর ন্যায়সঙ্গত পানি বণ্টনের চুক্তি করতে হবে এবং খুনি হাসিনা এবং পলাতক অপরাধীদের বাংলাদেশের কাছে প্রত্যার্পণ করতে হবে। হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার চেষ্টাই ভারতের বিচ্যুত পররাষ্ট্রনীতিকে যৌক্তিক কক্ষপথে ফিরিয়ে আনবে এবং সেটাই হবে ভারতের জন্য উত্তম পন্থা।’