মাজারে হামলা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাজারে হামলা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পোঁছেছে। পুলিশ সদর দপ্তর এ নিয়ে সারাদেশের থানাগুলোকে সতর্ক করে দিলেও কত মাজারে হামলা হয়েছে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই তাদের কাছে। তবে মাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট বড় মিলিয়ে ৫০টির বেশি মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে এইসব হামলার ব্যাপারে উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে কয়েক দিন ধরে মাজারে হামলা করার কথাও বলা হয়েছে। তবে এইসব হামলার ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কী না সেই খবর দিতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর।
গত ৫ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের দেওয়াবাগ দরবার শরীফে হামলা ও আগুন দেওয়া হয়। তারপর থেকে দেশের আরও কিছু মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোনো কোনো মাজারে গান বাজনাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঢাকার গাজীপুরে একটি মাজার বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মাজারগুলোতে ভক্তদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায়ও নেমেছেন।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ইয়াজোড়া দরবার শরীফের প্রধান খাদেম সৈয়দ গোলাম মঈন উদ্দিন ভান্ডারি জানান, গত ৯ সেপ্টেম্বর ওই দবার শরীফে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। হামলার পর মাজারটি পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এলাকায় আরও সাত-আটটি মাজারে হামলা হয়েছে। সারাদেশ কমপক্ষে ৫০টি মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে।
সৈয়দ গোলাম মঈন উদ্দিন ভান্ডারি আরও বলেন, ‘‘এই হামলায় যারা অংশ নিয়েছে তারা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। স্থানীয় কয়েকটি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি স্বার্থান্বেষী মহল ব্যবহার করেছে। এখানে চিন্তার ভিন্নতা আছে। সেটা থাকতেই পারে। ওহাবী ভাবধারার আমরা অনুসারী না। আমরা সুফিবাদে বিশ্বাসী। তাই বলে আমাদের ওপর হামলা হবে?”
সারাদেশে তিন হাজারেরও বেশি মাজার আছে। সব মাজারের ভক্তরাই এখন উদ্বিগ্ন। এইরকম পরিস্থিতি আগে কখনো হয়নি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “হামলার পর পুলিশ এসে কী হবে। আমরা হামলার আগেই নিরাপত্তা চাই।”
গোলাপ শাহ মাজারের খাদেম হাজি মো. জাকির হোসেন মোল্লা বলেন, “বাংলাদেশে পীর ওলির হাত ধরেই ইসলাম এসেছে। বাংলাদেশে ৩৬০ জন ওলি আউলিয়ার আগমন হয়েছে। তাদের হাত ধরে আরো অনেক অলির জন্ম এখানে। এখন একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী তাদের মাজার ও দরবারের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তিপ্রিয় ভক্ত। গোলাপশাহ মাজারে হামলার হুমকি পাওয়ার পর আমরা ভক্তরা গত কয়েকদিন ধরে মাজার পাহারা দিচ্ছি। আমরা আমাদের বুক দিয়ে মাজার রক্ষা করব।”
তার কথা, “মুসলমানের দায়িত্ব এখন এইসব মাজার রক্ষায় এগিয়ে যাওয়া। আর আমরা ধৈর্য ধারণ করছি। আল্লাহর কাছে বিচার দিচ্ছি। রাষ্ট্র কী করবে সেটা রাষ্ট্রের বিষয়।”
হাজি মো. জাকির হোসেন আরও বলেন, “৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি মাজারে হামলা হয়েছে। যারা এই হামলা করছেন তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হয়। এই জনপদে অনেক ওলি আউলিয়ার মাজার আছে। তারা এখানে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রেখেছেন। যারা ইসলামের নামে মাজারে হামলা করছেন, তারা আসলে ইসলামকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন।”
সিলেটের হজরত শাহ পরাণ(র.) মাজারের খাদেম ফিরোজ মিয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, “৯ সেপ্টেম্বর রাত তিনটার দিকে ওরশ চলাকালে মাজারে হামলা করা হয়। তারা মাজারে ভাঙচুর করে। সিসি কামেরা ভাঙচুর এবং খুলে নিয়ে যায়। ভক্তদের (পাগল) মারপিট করে। হামলার সময় হামলাকারীরা বলে মাজারে গান বাজনা করা যাবে না। গাঁজা খাওয়া যাবে না। হামলার সময়ও সেখানে পুলিশ ছিল এবং তাদের উপস্থিতিতেই এইসব ঘটনা ঘটে। আমরা মামলা করেছি। মাজারে আরও পুলিশ দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের কষ্ট হলো এই প্রথম মাজারে হামলা হলো। ভক্তদের মারপিট করা হলো।”
তবে সিলেটের আরেকটি মাজার হজরত শাহজালাল (র.) মাজারে এই পরিস্থিতিতে আতঙ্ক থাকলেও এখনো হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেখানেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকার ত্বাকওয়া মসজিদের ইমাম মুফতি সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই ধরনের হামলা ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। কোনো অভিযোগ থাকলে তা প্রশাসনের কাছে জানানো যায়। কিন্তু হামলা করা বেআইনি।”
আর মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, “যারা হামলা করছে তারা উগ্রবাদী। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। আর যাতে হামলা না হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। এই হামলা যদি বন্ধ না হয় তার দায় শেষ পর্যন্ত এই সরকারকেই নিতে হবে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়া ইনামুল হক সাগর জানান, “পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কয়েকদিন আগেই এই হামলা যাতে না হয় সে ব্যাপারে পুলিশকে কঠোর অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। যারা হামলা করেছে তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে সারাদেশে মাজারে মোট কতটি হামলা হয়েছে, কতটি মামলা ও কতজনকে আটক করা হয়েছে; সেই তথ্য ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানাতে পারেননি।