সাইবার মামলায় গ্রেপ্তার না করতে বলা হয়েছে : নাহিদ ইসলাম
সাইবার নিরাপত্তা আইনে এখন যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেই মামলাগুলোয় কোনো পদক্ষেপ না নিতে এবং কাউকে গ্রেপ্তার না করতে আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে বলে শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জানিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম৷
অন্তর্বর্তী সরকারের দেড় মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইনে কয়েকটি মামলা হয়েছে৷ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কটূক্তি করার অভিযোগেও মামলা হয়েছে৷
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরাতো বলেছি—নিবর্তনমূলক যে আইনগুলো আছে, যেগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেবে, সেগুলো আমরা বাতিল অথবা সংশোধন করব৷ এই আইনগুলো সেই প্রক্রিয়াধীন আছে, পর্যালোচনায় আছে৷ যে মামলাগুলো হচ্ছে আমরা আইন মন্ত্রণালয়কে বলেছি, সেই মামলাগুলোয় যাতে পদক্ষেপ না নেওয়া হয়৷ গ্রেপ্তার করা না হয়৷ যেহেতু আইনটি পর্যালোচনার মধ্যে আছে৷’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘যারা মামলা করেছেন তাদের আমরা চিনি না৷ আমরা নিরুৎসাহিত করছি৷ একটি মামলা তো ধর্ম অবমাননার কথা বলে করা হয়েছে৷ আমাদের নামগুলো সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে৷ এই মামলাগুলো আমাদের বিব্রত করতে করা হচ্ছে কিনা এটাও আসলে আমাদের একটু দেখতে হবে৷’
ড. ইউনূসকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় মামলা
২৬ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য ও হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে পটুয়াখালীর আদালতে মো. মাসুম বিল্লাহ (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেছেন হাসান মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি৷ ওই জেলার কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আশিষ রায় বাদীর অভিযোগ আমলে নিয়ে কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছেন৷
ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা
এর আগে ২৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং সেনাপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুর থানার হারিয়াছড়ি গ্রামের মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়৷ মামলা করেন একই গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন নামে এক ব্যক্তি৷ ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরান ও ধর্ম অবমাননার অভিযোগও আনা হয়েছে৷ সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের বিচারক জহিরুল হকের আদালতে মামলা করা হয়৷
মামলার আবেদন গ্রহণ করে আদালত পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) আগামী ২৭ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দিয়েছেন৷
সাইবার মামলায় হাসিনার আমল
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিজ বলছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট এক হাজার ৩৬টি মামলা হয়েছে তৎকালীন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, যা পরবর্তীতে সাইবার নিরাপত্তা আইনে পরিণত হয়৷ তাতে আসামি করা হয়েছে চার হাজার ৫২০ জন৷ তারমধ্যে এক হাজার ৫৪৩ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে৷ দুই হাজার ৯৮৬ জনের পেশাগত পরিচয় পায়নি সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিজ৷
যাদের পেশাগত পরিচয় জানা গেছে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতারাই সংখ্যায় বেশি, ৪৯৫ জন৷ তারপরই রয়েছে সাংবাদিক ৪৫১ জন৷ এ ছাড়া সরকারি চাকুরে, চিকিৎসক, এনজিওকর্মী, আইনজীবী, ছাত্র, শিক্ষক রয়েছেন৷
শতাংশ হিসাবে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ৩২.২৭ শতাংশ এবং সাংবাদিক ২৯.৪ শতাংশ৷ এইসব মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৮ জন আছেন, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে৷
মামলায় এক হাজার ৫৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ১৪৩ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ছাত্র ১০৪ জন এবং সাংবাদিক ৯৭ জন৷
মামলা দায়েরকারীদের মধ্যে শীর্ষে আছে র্যাব, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা৷ ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারাই সবচেয়ে বেশি মামলা করেছেন, ৩৩৪টি৷ যেসব রাজনৈতিক লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা প্রায় সবাই বিরোধী নেতা-কর্মী৷ এইসব মামলায় শাস্তি হয়েছে খুবই কম৷ তারপরও জেলে থাকতে হয়৷ হয়রানির শিকার হতে হয়৷ এই মামলার আসামি লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগারেই মারা যান৷
আর্টিক্যাল নাইনটিন বলছে, শুধু ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তারমধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে৷
‘এখনও এই আইনে মামলা হওয়া দুঃখজনক’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরিফুজ্জামান বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি বিষয় ছিল বাকস্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা৷ এই স্বাধীনতার পথে বাধা নিবর্তনমূলক আইনগুলো বাতিল করা৷ কিন্তু এখনও সেই সাইবার আইনে মামলা হওয়া দুঃখজনক৷ এই আইনে কথা বলার জন্য অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ নির্যাতন করা হয়েছে৷ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেও এই আইনে মামলা হয়েছে৷’
শরিফুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা, সেই জায়গা থেকে দ্রুত এই আইনটি বাতিল করা দরকার৷’
আর নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার বলেন, ‘এই আইনটি পুরোপুরি একটি নিবর্তনমূলক আইন৷ বিগত সরকার তার অপকর্ম, দুর্নীতি অব্যাহত রাখতে এই আইনটি ব্যবহার করেছে৷ এই আইনের মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে৷ এই আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদকে তো রিমান্ডে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ তারপরও এই আইন থাকে কীভাবে?’
‘গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার এসেছে৷ তাই তাদের জনপ্রত্যাশা পূরণ করে এই আইন বাতিল করতে হবে৷ এই আইনে মামলা বা গ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে’, বলেন সাকিব আনোয়ার৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘শেখ হাসিনার নিবর্তনমূলক আইনে এখনও কীভাবে মামলা হয়! প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাকে কটূক্তি করলে তারা দেখবেন৷ তাতে অন্যের কী? যারা মামলা করেছেন তাদের বিরুদ্ধেই এখন মামলা করা উচিত৷’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান আরও বলেন, ‘এই আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে৷ এর অপব্যবহার এখনই বন্ধ করতে হবে৷ আর এই আইনে এখন পর্যন্ত দায়ের করা সব মামলা বাতিল করতে হবে৷’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সাইবার অপরাধ দমনে আইনের দরকার আছে৷ কিন্তু এই হয়রানিমূলক আইন চলতে পারে না৷ আমরা শুরু থেকেই তাই এর বিরোধিতা করেছি৷ এখনও এই আইনের অপব্যবহার অগ্রণযোগ্য৷’
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আইনটি পরিবর্তন বা বাতিলের আগে সরকার চাইলে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়ে এই আইনে মামলা নেওয়া বা এর অপব্যবহার বন্ধ করতে পারে৷’