সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন করতে যা প্রয়োজন
রাজধানীর সিরডাপে 'নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই?' শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন তরান্বিত করতে বক্তব্যে তুলে ধরেছেন নানা পরিকল্পনা।
রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) সভাপতি একরামুল হক সায়েম। সঞ্চালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবীর।
আজ শনিবার (১২ অক্টোবর) সেমিনারে অন্তর্বর্তী সরকারের ও পাট এবং নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমাজের প্রতিনিধারা ও আরএফইডির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে যে সংকট রয়েছে সে সংকট নির্বাচনকেন্দ্রীক বলে মনে করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি বলেছেন, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে উচ্চ আদালতের রেফারেন্সে এই সরকার গঠিত হয়েছে যার ফলে এটা একটা সাংবিধানিক সরকার।
আসাদুজ্জামান রিপন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি একেবারে যৌক্তিক নয় দাবি করে বলেন, বাস্তবতার নীরিখে যা সংস্কার করার জন্য দরকার, তাই করা হবে। বিনা প্রতীদ্বন্দ্বীতায় ভোট হওয়া উচিত না। প্রয়োজনে পুনরায় ভোট করতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, আগামী ১০০ বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা উচিত। পরের শতাব্দীতে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম বিবেচনা করবেন, কী করা উচিত। শিক্ষকরা রাতের ভোটের সহযোগী ছিলেন। এক্ষেত্রে আমাদের স্কাউটদের গার্লস গাইডদের ব্যবহার করতে পারি। সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে তিন বছরের বাধ্যবাধকতা বাড়িয়ে পাঁচ বছর করা উচিত।
নির্বাচন পদ্ধতি চালু হবার পর থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বার বার বলা হয়েছে বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারকে একাকার করলে যে দূরবস্থা হয় সেটাই হয়েছে বাংলাদেশে। ঐক্যমত শব্দটা আপেক্ষিক দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপির ওপরে অনেক দায়িত্ব। সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি কিন্তু অভিভাবকের পরিচয় দিয়েছে। নির্বাচিত হলেও পরে অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
বর্তমান সংবিধান প্রসঙ্গ তুলে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, সব জায়গায় কিছু কিছু নতুন জিনিস সংযুক্ত দরকার। একই মঞ্চে সবাই প্রচারণা করতে পারেন।
রুল অব ল না রুল অব জাস্টিস হওয়া উচিত হয়ে জানিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে।
নির্বাচনচলাকালীন সময়ে উচ্চ আদালতে কমিশনের মতামত না নিয়ে কোনো রিট গ্রহণ করা হবে না জানিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল আছে তারা সব আসনে প্রার্থী দেন না। সারাদেশ থেকে সব প্রার্থী এনে সেই আসনে জমা করে। এটাও একটু সুক্ষ্ম কৌশল।
রাজনৈতিক দলগুলোর সুষ্ঠু নির্বাচন করার আন্তরিকতার অভাব আছে বলে দাবি করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রস্তাব দেওয়া। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই প্রস্তাব তৈরি করবে। সেই প্রস্তাব সরকার দেখবে তারপর আবারও অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসা।
প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকী বলেন, তিন থেকে পাঁচটি নির্বাচন নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হতে হবে। মানসিকতার বদল ও আইন করার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে না। যার ফলে হয়তো আমরা একটা জায়গায় পৌছাবো যেখানে দলীয় সরকারে অধীনে ভোট করা সম্ভব।
সে সময় সংখ্যানুপাতিক ভোটের প্রস্তাবের আলাপ তুলেছেন জোনায়েদ সাকী। না ভোটের বিধান রাখার পক্ষে মত দেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুস্পষ্ট কথা শুনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। বলেন, প্রথমে ওনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) এসে বললেন, অনেকগুলো সংস্কার কাজ করবেন। তিনমাস সময় দেওয়া হলো তিনমাস পরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। ওনারা এখনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ করলেন না। তাহলে কি কালক্ষেপন? এই তিনমাস সময় লাগার তো কথা না?
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সংবিধান সংস্কার করার পক্ষে সমর্থণ জানিয়ে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, অনেকদিন ধরে দেশে যে সংকট সেই ব্যবস্থা উচ্ছেদের আকাঙ্খা আমরা করলাম। অন্তর্বর্তী সরকার কেন অপেক্ষা করছে প্রশ্ন তুলে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া ও প্রচলিত ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আনুপাতিক ব্যবস্থা জরুরি।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট এবং প্রাদেশিক সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে জানিয়ে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, না ভোট প্রবর্তন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন নিজেই একটা কমিশন তার আবার সংস্কার কমিশন কেন প্রয়োজন এমন প্রশ্ন তুলেছেন আমার বাংলাদেশ এবি পার্টি সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলাম কমিশন নিজেই কমিশন। বদিউল আলমকে সরাসরি প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে দিলে পারত।
সংস্কার শব্দটা বড় করে দেখা দিয়েছে জানিয়ে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আইনি যে কাঠামো আছে এগুলো ব্যবহার করে স্বচ্ছ নির্বাচন করা যায়। সংস্কারের চেয়ে কুসংস্কারের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। প্রার্থীরা পছন্দের ডিসি এসপি নেওয়ার জন্য তদবির করে। কেন্দ্রভিত্তিক দখলদারিত্ব ও ডামি প্রার্থী দেওয়া এগুলো ইলেকশন রিগিংয়ের ছোটো ছোটো পয়েন্ট। এবারের ইলেকশন বাংলাদেশ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে জামায়াতের পক্ষ থেকে নয়টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান সাবেক শিবির সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক ভোট চেয়েছি। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচনের জন্য সংবিধানে সংশোধন এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফেরত আনা। তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনের হওয়া নির্বাচন অন্যন্য নির্বাচনের চেয়ে জনগনের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। নিবন্ধন প্রথা বাতিলের পাশাপাশি একাধিক দিনে নির্বাচন আয়োজন ডিজিটালা মেশিন ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। সরকারি চাকরিজীবি চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে ভোট করতে পারবেন না। স্থানীয় সরকারের দলীয় প্রতীক প্রথা বাতিল করতে হবে।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চুইংগামের মত কাস্টিং বাড়িয়ে ভোট ৪০ শতাংশ দেখানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যরিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। সংসদ সদস্যদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব তুলে তিনি বলেন, দশ লাখ টাকা বেতন দিতে হবে। যে সরকার থাকবে সে সরকার চাইলে নির্বাচন প্রভাবিত হয়েছে। একটা ভোটে কত শতাংশ এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ভোট হবে সেটা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে পুনরায় ভোট করতে হবে।
স্থানীয় সরকার ভোট নির্বাচন কমিশন করবে কি না সেই প্রশ্ন তুলে শামীম বলেন, অনুপাতিক ভোট হলেও সকলের অংশগ্রহণ থাকবে। ছোটো ছোটো দল ক্ষমতায় আসতে পারবে। এই সরকারের অধীনে যে ভোট হবে সেটি সুষ্ঠু হবে। তবে পরের ভোট টি কি হবে সেদিকে নজর রাখতে হবে।