কারাবিধি যুগোপযোগী করে কারাগারকে সংস্কারের দাবি বিশিষ্টজনদের
কারাগারের অনিয়ম বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, অপরাধীরা যেন কারাগার থেকে সংশোধনের সুযোগ পায়, পাশাপাশি দেশে বিদ্যমান জেল কোড, দণ্ডবিধি যুগোপযোগী করে কারাগারকে সংস্কারের কথা বলেছেন বিশিষ্টজনেরা।
‘কারাগার সংস্কার : বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় রাজধানীতে আজ শনিবার (১৯ অক্টোবর) বক্তারা এসব কথা বলেন। আইন, আদালত, মানবাধিকার ও সংবিধান বিষয়ক সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) ও কারা অধিদপ্তর যৌথভাবে এই কর্মশালার আয়োজন করে।
এলআরএফের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান জাবেদের সভাপতিত্বে কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মিশন। কর্মশালা সঞ্চালনা করেন প্রশিক্ষণ ও কল্যাণ সম্পাদক জাভেদ আখতার ও নিউ এজ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সিনিয়র সাংবাদিক শহীদুজ্জামান।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহার হোসেন কারা সংক্রান্ত বিদ্যমান ব্যবস্থা নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ‘জেল সংস্কার : সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও প্রস্তাবনা’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস। আলোচনায় অংশ নেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও বার কাউন্সিলের এনরোলমেন্ট কমিটির সদস্য সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ, কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির, সাবেক কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, বিগত ১৫ বছর মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেনি। ভয়ের সংস্কৃতি, ভয়ের শাসন ও ফ্যাসিবাদের কারণে স্বাধীনভাবে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মানবাধিকার নিয়ে রিপোর্ট করায় তাকে দুবার জেলে যেতে হয়েছে। প্রথমবার তাকে তুলে নেওয়া হয় এবং রিমান্ড শেষে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। দ্বিতীয়বার মামলায় দুই বছরের দণ্ড দিয়ে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
আদিলুর রহমান খান বলেন, কারাগারগুলোকে সংস্কারের চেষ্টা করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হতে হবে। এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপারিশ করবে। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচারবিভাগ সংস্কার কমিশন কাজ করছে। তারা জেল কোড যুগোপযোগী করতে সুপারিশ করবেন।
উপদেষ্টা বলেন, দেশে বহু নির্যাতিত মানুষ রয়েছে। আদালত থেকে নির্যাতিত মানুষরা যেন বিচার পায় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কুষ্টিয়া আদালতে মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান রক্তাক্ত হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। আরও কমিশন গঠন আলোচনার ব্যাপার।
বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, বাংলাদেশের জেল কোড ১৯৮৯ সালে সর্বশেষ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে কারা সংস্কারে উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে কারাগার আমাদের সমাজেরই অংশ। কারাবন্দি একজন মানুষের শুধু ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট থাকবে না। তার ভোটাধিকার বা অন্যান্য ফ্রিডম রেসট্রিকটেড থাকবে না। রায় মানতে দেশের প্রতিটি নাগরিক বাধ্য। রায়ের সমালোচনা করার অধিকার সবার রয়েছে।
কারা ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী করতে গুরুত্বারোপ করে ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, কারা আইন সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। মানবিকভাবে কারাগারগুলোকে গড়ে তুলতে হবে। জেল কোড ও দণ্ডবিধি সংশোধন করে যুগোপযোগী করা এখন সময়ের দাবি। তিনি তার কারাজীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কারাগারের ভিতরের দুর্নীতি এবং বিভিন্ন বৈষম্য তুলে ধরেন ব্যারিস্টার কাজল। কারাগারগুলোকে সংশোধনাগার হিসেবে সত্যিই প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও প্রয়োজন। কারা ব্যবস্থাপনা যুগোপযোগী করতে হলে সংশ্লিষ্টদের তেলবাজি ও দলবাজি পরিত্যাগ করতে হবে।
আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, কারাবন্দিদের সংশোধনের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন। কারাগারে নারী ও শিশুরা নানা ধরনের বৈরী আচরণের মুখোমুখি হয়। তিনি বিদ্যমান কারা ব্যবস্থা সংস্কারের ওপর জোর দেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহার হোসেন বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৭টি কারাগারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তীতে সব কারাগারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। দেশের সব কারাগারে এখন নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশ রয়েছে।
কারা ব্যবস্থাকে আধুনিক করার ওপর গুরুত্বারোপ করে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি লোক থাকে। অনেক সময় তা অমানবিক পর্যায়ে চলে যায়। এটির সমাধান জরুরি।
কারা উপ-মহাপরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবির বিদ্যমান কারাগার ব্যবস্থায় বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন। এর মধ্যে বন্দির তুলনায় অপ্রতুল স্থান, প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও ব্যবস্থা না থাকা। পাশাপাশি কারা কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধায় রয়েছে নানা বৈষম্য। এসব বৈষম্য নিরসনের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
কর্মশালায় মূল প্রস্তাবনা তুলে ধরে অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, কারগার মূলত সংশোধানাগার। কারাগারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অপরাধীর সংশোধন। বর্তমানে কারাগার ব্যবস্থা সংশোধনমূলক তত্ত্বনির্ভর। জেলগুলো মূলত ১৮৬০ সালের জেল কোড, দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট ও দ্য প্রিজনার্স অ্যাক্ট আইনসমূহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব আইন ঔপনিবেশিক আমলে আনা। এসব আইন সংশোধন করে জেল ব্যবস্থা সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
শিশির মনির বলেন, ১৯৭১ সালে তিনটি কেন্দ্রীয় কারাগার, ১৩টি জেলা কারাগার, ৪৩টি উপ-কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেলের যাত্রা শুরু হয়৷ ১৯৯৭ সালে উপ-কারাগারগুলোকে জেলা কারাগারে পরিণত করা হয়। বর্তমানে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার, ৫৫টি জেলা কারাগার নিয়ে বাংলাদেশ জেল ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় অনেক বিষয় জেল কোডে নেই। আবার বিদ্যমান আইনে রয়েছে এমন অনেক সুবিধা কার্যকর ও প্রয়োগ হচ্ছে না। এটির সমাধান জরুরি।
কারাগার ব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন শিশির মনির। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে কনডেম সেলে এবং কারাগারে নির্জন স্থানে রাখা আইনের লঙ্ঘন।
শিশির মনির আরও বলেন, বন্দিদের কনডেম সেলে রাখা হয়, যখন তাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়। এ ধরনের বন্দিদের মনস্তাত্ত্বিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক মানবিক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর প্রক্রিয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি বিষয়। তাই এটি আইনের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে এবং বন্দির মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে কনডেম সেলে রাখা যাবে না। বন্দিদের জন্য স্বামী-স্ত্রীর সহবাস ও প্রজননের অধিকার একটি মানবিক প্রয়োজন। এই অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত জীবন ও মানবিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন সম্ভব।
এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরে শিশির মনির বলেন, কারাগার সংস্কার অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোনো আইন এবং জেল কোডের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার, মানবাধিকার ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের সমন্বয় করে জেল ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।