আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুণ্ডুবাড়ির মেলা শুরু
চার স্তরের নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অবশেষে শুরু হলো মাদারীপুরের আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুণ্ডুবাড়ির মেলা। প্রতি বছর কালীপূজা ও দীপাবলি উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এ মেলা। কিন্তু এবার অশ্লীলতা, চাঁদাবাজি, মাদক, জুয়াসহ নয়টি অভিযোগ এনে সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে মেলাটি বন্ধ ঘোষণা করা হলো—এমন ব্যানার পৌর এলাকার বিভিন্নস্থানে টানিয়ে দেওয়া হয়। তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এ ঘটনা নিয়ে পুরো জেলাসহ সারা দেশে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। পরে মেলার বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এবং কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে কয়েক দফা আলেম সমাজ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা করে প্রশাসন। পরে উপস্থিত সবার সম্মতিক্রমে পূজা উদযাপন কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন দিনের মেলার অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে খুশি স্থানীয়দের পাশাপাশি পূজা উদযাপন কমিটি।
তবে বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে এ মেলার ইজারা বাতিল করে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প তৈরি করে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে থাকবে প্রশাসন। অপর দিকে মেলাস্থল পরিদর্শন করেছে বিভিন্ন প্রশাসন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বরিশাল সেনানিবাসের কর্নেল তারিক মাহমুদ, লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মামুন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার দাশ, কালকিনি থানার ওসি মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, মেজর মো. মুনতাসীর মামুন গৌরব, ক্যাপ্টেন আবু আমিন প্রমুখ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কালকিনি পৌর এলাকার গোপালপুরের কুণ্ডবাড়িতে ১৭৮৩ সালের নভেম্বরে দীপাবলি ও শ্রীশ্রী কালীপূজা উপলক্ষে দীননাথ কুণ্ড ও মহেশ কুণ্ডু এই মেলা প্রবর্তন করেন। তাই কুণ্ডুদের বংশের নামানুসারে এই মেলা নামকরণ করা হয় কুণ্ডুবাড়ির মেলা। এই সময় দীপাবলির পরের দিন এই অঞ্চলের বিভিন্ন কালী প্রতিমা জড়ো করা হতো। এর মধ্যে যাদের প্রতিমা সর্বাধিক থেকে সেরা হতো তাদের পুরস্কার দেওয়া হতো। সেই সময় বিনোদনের জন্য পুতুল নাচ, কবিগান, জারি গান, পালাগান, নৌকাবাইচের আয়োজন করা হতো। কালের বিবর্তনে পালাগান জারি গান, নৌকা বাইচ বন্ধ থাকলেও নাগর দোলার আয়োজন এখনও আছে। বংশপরম্পরায় প্রতি বছর এই মেলা আয়োজন করা হয়ে থাকে। বর্তমানে শুধু কুণ্ডুবাড়িজুড়ে নয় প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মেলা বসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত দোকানি বিভিন্ন পণ্যের পশরা সাজিয়ে বসে। কাঠের বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্রের জন্য এই মেলা বিখ্যাত। মেলায় মাদারীপুর ছাড়াও ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, বরিশাল, খুলনা, বাগেরহাট, মাগুরা, যশোর, নড়াইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা তাঁদের মাটির, বাঁশের ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন মালামাল ট্রাকযোগে এনে বিক্রি করেন।
মেলায় আসা সমীর নামের এক কাঠের আসবাবপত্র ব্যবসায়ী বলেন, আমরা ৫৫ বছর ধরে এই মেলায় আসবাবপত্র বিক্রি করার জন্য আসতেছি। এ মেলায় কাঠের আসবাবপত্র বেশি বিক্রি হয়। ক্রেতাদের চাহিদা বুঝে বিভিন্ন ডিজাইনের আসবাবপত্র মেলায় নিয়ে এসেছি। অনেক কাঠের আসবাবপত্রের দোকান বসেছে মেলায়। তবে এ বছর প্রথমে শুনেছিলাম এ মেলা হবে না।
মেলাস্থলে ঘুরতে আসা বেশ কয়েকজন মেলাপ্রেমী বলেন, দক্ষিণবঙ্গের সর্ববৃহৎ এ মেলা দেখার জন্য দূর থেকে এসেছি। এত বড় মেলা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। সব ধরনের জিনিসপত্র মেলায় পাওয়া যায়।
মেলার আবেদনকারী স্বপন কুণ্ডু বলেন, চলতি বছরে আমাদের এ মেলা নিয়ে একটু সমস্যা তৈরি হলেও আমরা এ মেলার অনুমোদন পেয়েছি। তাই আমাদের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই। তবে দীপাবলি ও শ্রীশ্রী কালীপূজা উপলক্ষে আমাদের পূর্ব পুরুষরা মাত্র চার একর জমির উপর এই মেলার আয়োজন করেন। পরে ধীরে ধীরে এই মেলা বিস্তৃত হয়ে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রতি বছর এই মোলায় কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী বিক্রি হয়। তবে এ বছর মেলাকে কেন্দ্র করে সর্বক্ষণিক চার স্তরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকবে।
এ ব্যাপারে কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার দাশ বলেন, প্রথমে মেলা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও সেই সমস্যা কেটে গেছে। পূজা উদযাপন কমিটি, সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মেলা পরিচালিত হবে। মেলায় আগত দোকানি, দর্শনার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তায় কাজ করবে প্রশাসন। সবার সম্মতিতেই এবার সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত হবে কুণ্ডুবাড়ির মেলা।