শেখ হাসিনার হাতে আবদুল জলিলের ‘ট্রাম্পকার্ড’
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/11/11/shekh_haasinaa.jpg)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ট্রাম্পকার্ড’ যুক্ত হয় ২০০৪ সালে। ওই বছর ‘ট্রাম্পকার্ড’ খেলে আলোচিত হয় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে কার্ডটি খেলতে চেয়েছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। আবারও সেই ট্রাম্পকার্ড এসেছে আলোচনায়। আর তা খেলছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী পলাতক শেখ হাসিনা নিজেই।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জীবন বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। সেখান থেকে একের পর এক তাঁর ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে। এসব ফোনালাপের একটিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে হটাতে ‘ট্রাম্পকার্ড’ খেলার ফরমুলা দিতে শোনা যায় তাঁকে।
জলিলের ট্রাম্পকার্ডের প্রভাব
বছরটি ছিল ২০০৪। ওই বছরের এপ্রিলের শুরুতে হঠাৎই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। সেখানে ঘোষণা দেন ‘আগামী ৩০ এপ্রিল বিএনপি সরকারের পতন হবে।’ এই সময় বেঁধে দেওয়ার ভিত্তি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল জানিয়েছিলেন, ‘আমার হাতে একটি ট্রাম্পকার্ড রয়েছে। ওই দিন আমি এটি ছুঁড়ব। তাতেই বিএনপি সরকারের পতন হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এমন ট্রাম্পকার্ডের ঘোষণায় তৎকালীন সরকারসহ পুরো জাতি নড়েচড়ে বসে। সাংবাদিকরা প্রতিদিনই এ বিষয় নিয়ে তাঁর স্মরণাপন্ন হন। তিনিও অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই ৩০ এপ্রিল তাঁর হাতে থাকা ‘ট্রাম্পকার্ড’ খেলবেন বলে সাংবাদিকদের নিশ্চিয়তা দেন। তবে, সাংবাদিকরা অনেক পীড়াপিড়ি করলে তিনি সেই ‘ট্রাম্পকার্ড’ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলতেন, ‘৩০ এপ্রিলই সেটি দেখতে পাবেন। আমরা সরকার পতন উদযাপন করব।’
২০০৪ সালের ২৯ এপ্রিল। আবদুল জলিলের সেই ট্রামকার্ড নিয়ে উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা। তিনিও ট্রাম্পকার্ড নিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসে নিজের অবস্থানে অটল।
অবেশেষে ৩০ এপ্রিল অন্য দিনগুলোর মতোই পূর্বদিগন্তে দেখা দেয় সূর্য। তা দুপুর গড়িয়ে বিকেলের নরম গোধূলি পেরিয়ে পশ্চিমাকাশে অস্ত যায়। কোথাও দেখা মেলে না সেই ট্রাম্পকার্ডের। ওই দিনের ঘটনা নিয়ে দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে লিড স্টোরি হয়। দৈনিক যুগান্তরের প্রধান শিরোনাম ছিল ‘আজ ৩০ এপ্রিল : কারও মনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নেই।’
যেভাবে হাসিনার হাতে এলো সেই ট্রাম্পকার্ড
আবদুল জলিল এখন না থাকলেও তাঁর সেই বহু আলোচিত ট্রাম্পকার্ড ফের আলোচনায়। দুই দশক পর সেই আলোচনায় বলা হচ্ছে, এবারের ট্রাম্পকার্ড খেলার দায়িত্ব নিয়েছেন আওয়ামী লীগের পলাতক সভাপতি নিজেই। প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে জনতার অগোচরে আকাশপথে আত্মগোপন করে বাংলাদেশ সীমান্ত পারি দেওয়া শেখ হাসিনাই মেতেছেন খেলায়। তাঁর ফোনালাপের সত্যতা নিয়ে তর্কবিতর্ক থাকলেও শহীদ নূর হোসেন দিবসের ষড়যন্ত্র অনেকটাই নিশ্চিত করে দিয়েছে সব। যেখানে যে ছক তিনি আঁকেন তা গতকাল পরিষ্কার হয়ে যায় জনতার সামনে। সেখানে শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে মিছিল করার নির্দেশ দেন। সেই মিছিল ও হামলার ছবি তুলে ট্রাম্পের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ছক আঁকেন তিনি। যদিও ট্রাম্পকে নিয়ে আঁকা শেখ হাসিনার সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তবে, ট্রাম্পকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের ছক আঁকায় দুই দশক আগের আবদুল জলিলের সেই ‘ট্রাম্পকার্ড’টি ফের আলোচনায়।
এবারের ট্রাম্পাকার্ড ষড়যন্ত্রে যা ছিল
শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া ফোনালাপে অপর প্রান্ত থেকে ‘আপা’ বলতে শোনা যায়। আর ‘আপা’ ১০ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচিতে ব্যানার ও পোস্টারে ‘জাতির জনক’ ও ‘নেত্রী শেখ হাসিনা’র ছবির পরিবর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, তোমরা আমার ও জাতির জনকের ছবির পরিবর্তে ট্রাম্পের ছবি দিয়ে পোস্টার বানিয়ে রাস্তায় মিছিল করবে। সরকার মিছিলে হামলা করলে তোমরা ছবি তুলবে। আগেই ক্যামেরাপারসন ঠিক করে রাখবে। ওই ছবি আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি সেগুলো ট্রাম্পের কাছে পাঠিয়ে দেব। ট্রাম্পের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ আছে।
এরপর থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে সেই ‘ট্রাম্পকার্ড’। শেখ হাসিনার এ নির্দেশনার পর শনিবার রাতে রাজধানী থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ১০ কর্মীকে ট্রাম্পের ছবি সংবলিত ফেস্টুনসহ আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
শেখ হাসিনার সেই ট্রাম্পকার্ড নিয়ে খেলে ভারতীয় গণমাধ্যমও
১০ নভেম্বর ছিল শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে গণতন্ত্র মুক্তির দাবিতে নূর হোসেনের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট। সেই নূর হোসেন চত্বরে ট্রাম্পকার্ড খেলতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ফাঁস হওয়া অডিওর সত্য-মিথ্যা নিয়ে বাহাসে ৯ নভেম্বর যখন ব্যস্ত ছিল নেট-দুনিয়া, তখন আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ডাক দেওয়া হয় মিছিল-সমাবেশের। বিকেল ৩টায় শহীদ নূর হোসেন চত্বরে এই সমাবেশের ডাক দেয় তারা। সরকার পতনের তিন মাস পর ঢাকায় প্রথম বারের মতো কর্মসূচি দেয় দলটি। যদিও একই দিনে সকাল থেকে একই স্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও গণজমায়েত করবে বলে জানায়। এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের গণজমায়েত হলেও দেখা যায়নি আওয়ামী লীগের ব্যানারে কাউকে।
এরপরও ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করায় বাংলাদেশে তাঁর সমর্থকদের বিজয় মিছিলে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং ফেস্টুন-ব্যানার জব্দ করা হয়েছে। এমন প্রতিবেদনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ‘ফাঁস হওয়া’ ফোনালাপের যেমন সত্যতা মেলে তেমনি তাঁর পাশে থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমকেও ট্রাম্পকার্ড খেলতে দেখা যায়।
৩০ এপ্রিল ও ১০ নভেম্বরের ট্রাম্পকার্ড
২০০৪ সালের সালতামাতিতে বছরের আলোচনার শীর্ষে ছিল আবদুল জলিলের সেই ট্রাম্পকার্ড। ৩০ এপ্রিলের দৈনিক যুগান্তর ট্রাম্পকার্ড ইস্যুতে লিখে, ‘আজ সেই ৩০ এপ্রিল। নানা প্রশ্নে বিদ্ধ, নানা বিশেষণে বিশেষায়িত একটি অন্যরকম দিন। একটি মাত্র ঘোষণাকে ঘিরে রাজনীতিতে এমন তোলপাড়, আলোড়ন, শঙ্কা আগে কেউ কোনোদিন দেখেনি। প্রায় মাসখানেক আগে আবদুল জলিল ‘৩০ এপ্রিল ডেডলাইন’ ও পরে ট্রাম্পকার্ডের কথা বলেছিলেন। যাতে নানা জল্পনাকল্পনা, উদ্বেগ- উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছি।’
ট্রাম্পকার্ডের অস্তিত্ব নিয়ে ওদিন দৈনিক ইত্তেফাক ‘ট্রাম্পকার্ড এখনও আমার হাতে, তবে কিছু সময় নিয়েছি : জলিল’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল জলিল বলেছেন, ‘যুদ্ধে যেমন কৌশল থাকে তেমনি ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকার পতনের ঘোষণা ছিল তার একটি রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু বিভিন্ন অবস্থার কারণে পরিকল্পনায় কিছুটা ব্যত্যয় ঘটায় ‘ডেডলাইন’ পূরণ করতে পারিনি। তবে, আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইনি।’
ট্রাম্পকার্ডের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল জলিল বলেন, এই ট্রাম্পকার্ড এখনও আমার হাতে আছে। সময়মতো তা ব্যবহার করা হবে। কারণ এটা হচ্ছে সরকার পতনের জন্য সর্বশেষ হাতিয়ার।’
এদিকে, ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বরে শেখ হাসিনার ট্রাম্পকার্ডটি নিয়েও ভারতীয় গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও হয় হেডলাইন। এনটিভি অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ হয় ‘শেখ হাসিনার সুরে সুর মেলাল ভারতের শীর্ষ গণমাধ্যমও’, ঢাকা পোস্টের হেডলাইন ছিল—“ঢাকায় ট্রাম্পের সমর্থক আটক’-সহ আ.লীগ নিয়ে যা বলছে ভারতীয় মিডিয়া”। আর ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং ফ্যাক্টস বলছে, বাংলাদেশে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের তথ্য ভুয়া।