ভারত থেকে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশের ৭৮ নাবিক
বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় জলসীমায় মাছ ধরার অভিযোগে গত সোমবার বাংলাদেশের ৭৮ জন নাবিককে আটক করেছে ভারতীয় কোস্টগার্ড৷ তাদেরকে আটকের পর উড়িশ্যা রাজ্যের প্যারাদ্বীপে নিয়ে রাখা হয়।
ওড়িশ্যা রাজ্য পুলিশকে উদ্ধৃত করে ভারতের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ৭৮ জনকেই ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে৷ গত তিন মাসে বাংলাদেশেও ৯৫ জন ভারতীয় নাবিককে আটক করা হয়৷
বুধবার ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদের হাতে আটক বাংলাদেশি ফিশিং ট্রলারের ৭৮ নাবিকের ছবি প্রকাশ করে৷ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা দাবি করে, ভারতীয় জলসীমার মধ্যে মাছ ধরার সময় ৭৮ জন নাবিকসহ দুটি ফিশিং ট্রলার আটক করা হয়৷ গত সোমবার সকালে ফিশিং ট্রলার ও নাবিকদের আটক করে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্ট গার্ড৷
বাংলাদেশের সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের কোস্ট গার্ডের মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে৷ নাবিক ও ফিশিং ট্রলার দুইটি বাংলাদেশের জলসীমা থেকেই ভারতীয় কোস্টগার্ড আটক করে নিয়ে যায়৷”
ভারতীয় কোস্ট গার্ড তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডেলে যে তিনটি ছবি প্রকাশ করেছে তার একটি ছবিতে দেখা গেছে, ট্রলারের ডেকের ওপর বেশ কয়েকজন নাবিক মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন৷ তাদের পেছনে সশস্ত্র অবস্থায় ভারতীয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন৷ আরেক ছবিতে দেখা গেছে, সাগরে ট্রলার দুটি পাশাপাশি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ অন্য ছবিতে দেখা গেছে, একটি ট্রলার জেটিতে ভেড়ানো হয়েছে৷
ট্রলার দুটির মালিক প্রতিষ্ঠানের ভাষ্য, এফভি মেঘনা-৫ ও এফভি লায়লা-২ বাংলাদেশের জলসীমায় খুলনার হিরণ পয়েন্টে মাছ ধরছিল৷ ওই অবস্থায় সোমবার সকালে বোটে উঠে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বোটসহ নাবিকদের নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্টগার্ডের সদস্যরা৷ এফভি মেঘনা-৫-র মালিক প্রতিষ্ঠান সি অ্যান্ড অ্যাগ্রো লিমিটেড ও এফভি লায়লা-২-এর মালিক প্রতিষ্ঠান এস আর ফিশিং লিমিটেড৷ লায়লা-২ বোটে ৪২ জন এবং মেঘনা-৫-এ ৩৭ জন ছিলেন৷ এই ৭৯ জনের মধ্যে একজন আগেই নেমে গেছেন৷
বাংলাদেশ নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘দুই দেশের কোস্টগার্ডের মধ্যে একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে৷ সেখানে যোগাযোগ হচ্ছে৷ আর জলসীমা তো সুনির্দিষ্টভাবে তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করা যায় না৷ সেক্ষেত্রে সতর্ক করা হয়৷ সেটা না করে তারা নিয়ে গেছে৷ তারা এখন আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ তাই এখন আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করছি৷ আরেকটি বিষয় হলো, বোটের মালিক পক্ষ আইনগত দিক দিয়ে কীভাবে এগোবে, সেটা দেখা হচ্ছে৷”
এক প্রশ্নের জবাবে মাকসুদ আলম বলেন, ‘‘ভারতীয় কোস্টগার্ডের প্রকাশিত ছবি আমি দেখেছি৷ আটকদের মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ আমরা তাদের কাছ থেকে সম্মানজনক আচরণ আশা করি৷ আর আমাদের সমুদ্রসীমার মধ্য দিয়েই তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷”
এফভি লায়লা-২ এর মালিক প্রতিষ্ঠান এস আর ফিশিং লিমিটেডের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মিন্টু কুমার সাহা বলেন, ‘‘আটকের সময় আমাদের নাবিকরা ওয়্যারলেসে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছে যে, ট্রলার আমাদের সীমার ভিতরেই ছিল৷ ভারতের সীমা থেকে পাঁচ নটিক্যাল মাইল ভিতরে ছিল৷ ভারতীয় কোস্ট গার্ড এগিয়ে এসে ট্রলারে উঠে কন্ট্রোল নিয়ে নেয়। এরপর তারা একরকম জিম্মি করেই নিয়ে যায়৷ মাস্টারসহ আমাদের ট্রলারে ৪২ জন ছিলেন৷”
‘‘আমরা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি৷ এটা এখন দুই সরকারের মধ্যকার বিষয়৷ আটক নাবিকদের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন,’’ বলেন তিনি৷
আর এফভি মেঘনা-৫-এর মালিক প্রতিষ্ঠান সি অ্যান্ড অ্যাগ্রো লিমিটেডের সিইও সুমন সেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আমাদের নাবিকদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি৷ তাদের ট্রলার থেকে নামিয়ে নৌপুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ আমাদের ট্রলারে মোট ৩৭ জন ছিলেন৷ তারা যে ছবি প্রকাশ করেছে, তাতে নাবিকদের যেভাবে ছবি তোলা হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ তারা তো অপরাধী নয়৷ তারা বৈধ অনুমতি নিয়েই মাছ ধরছিলেন৷ আর ট্রলার আমাদের সীমার মধ্যেই ছিল৷ এখন বল ভারতের কোর্টে৷ শক্তি তাদের, তাই তারা তাদের মতো বলছে৷”
ভারতীয় উপকূলরক্ষী জাহাজ অমোঘ আইএমবিএল বরাবর টহলরত অবস্থায় ভারতীয় সামুদ্রিক অঞ্চলের মধ্যে সন্দেহজনক কার্যকলাপ শনাক্ত করেছে বলেও দাবি তাদের৷ ওই জাহাজটি অননুমোদিত মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশের দুটি ফিশিং ট্রলার আটক করেছে৷ জাহাজ দুটিকে এফভি লায়লা-২ এবং এফভি মেঘনা-৫ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ দুটি ট্রলারই বাংলাদেশে নিবন্ধিত এবং দুই ট্রলারে ৪১ ও ৩৭ জন ক্রু ছিলেন৷
ট্রলার দুটি ও নাবিকদের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভারতের ওড়িশ্যা রাজ্যের জগৎসিংহপুর জেলার প্যারাদ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
অন্যদিকে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে তিনটি ঘটনায় ৯৫ জন ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়েছে৷ জব্দ করা হয়েছে মাছসহ পাঁচটি ভারতীয় পতাকাবাহী ফিশিং ট্রলার৷
১৬ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকারের অভিযোগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতীয় পতাকাবাহী দুটি ফিশিং ট্রলারসহ ৩১ জেলেকে আটক করেভ তাদের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানায় হস্তান্তর করা হয়৷
কলাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুয়েল ইসলাম জানান, ‘‘আটক ভারতীয় জেলেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর পর তারা এখন কারাগারেই আছেন৷’’
এরপর ১৮ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অভিযোগে আরো ৪৮ ভারতীয় জেলেকে আটক করে বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড৷ তখন ভারতীয় তিনটি মাছ ধরার ট্রলারও জব্দ করা হয়৷ তাদের মোংলা থানায় হস্তান্তর করা হয়৷
সবশেষ গত ২১ নভেম্বর রাতে মোংলা বন্দরের অদূরে ফেয়ারওয়ে বয়া সংলগ্ন গভীর সাগর থেকে কোস্টগার্ড সদস্যরা ভারতীয় পতাকাবাহী একটি ফিশিং ট্রলার ১৬ ভারতীয় জেলেসহ আটক করে৷ আটকের পর ১৬ জনকেই মোংলা থানায় হস্তান্তর করা হয়৷ পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়৷
বাগেরহাটের মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আনিসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘দুটি ঘটনায় আটক জেলেদের বিরুদ্ধে থানায় দুটি মামলা হয়েছে৷ আমাদের কাছে হস্তান্তরের পর আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়৷ তারা কারাগারেই আছেন৷’’