গোমতী নদীর জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা, নীরব প্রশাসন
চলতি বছর গোমতী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রলয়ংকরী বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজারও মানুষ। গত ১০০ বছরেও এমন বন্যা দেখেনি কুমিল্লাবাসী। এবারের বন্যায় জমির ফসল হারিয়েছে। হারিয়েছে গবাদি পশু। ভেঙেছে তাদের সাজানো সংসার। নষ্ট হয়েছে হাজারও কিলোমিটার সড়ক। এবারের বন্যার মূল কারণ ছিল গোমতীর পানি সরতে না পারা। নদীর ভেতর অবৈধ স্থাপনা ও নদী শাসনের কারণেই বন্যা হয়েছে বলে মনে করেন গোমতীর তীরবর্তী মানুষজন। সম্প্রতি বন্যা পরবর্তী গোমতী দখলে মেতে উঠেছে কতিপয় প্রভাবশালী। এভাবে দখল দূষণের কারণে আসছে বছর আবারও বন্যার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এসব দেখার কেউ। নীরব প্রশাসন।
সরেজমিনে কুমিল্লা গোমতী নদীর গোলাবাড়ি ও বিবির বাজার থেকে শুরু করে অরণ্যপুর, সাহাপুর, জালুয়াপাড়া, টিক্কারচর, চাঁনপুর, ছত্রখীল, রত্নবতী, ভাটপাড়া, বানাশুয়া, পালপাড়া, আড়াইওড়া, দুর্গাপুর, বালিখাড়া, ভান্তি, বুড়বুড়িয়া থেকে গোবিন্দপুর, দেবিদ্বার ও মুরাদনগর উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, নদীর ভেতর অসংখ্য ছোট বড় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। যার মধ্যে বাড়ি, মসজিদ, মন্দির, কফিশপ রয়েছে। অনেক জায়গায় চরের জমি, দখল করে পাকা স্থাপনাও গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ স্থাপনার কারণে গোমতীর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়ে এ বছর গোমতীর দুকূল ছাপিয়ে বন্যা হয়েছে।
কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন জানান, এবারের গোমতীর ভাঙন তৈরি হয়েছে মূলত গোমতীর ভেতর অবৈধ স্থাপনার কারণে পানি সরতে না পারার জন্য। গোমতী নদীতে জোয়ার-ভাটা নেই। গোমতীতে পানি বাড়লেও তা এক বা দুই দিনের বেশি থাকে না। যদি পানি প্রবাহে বাধা না পেতো তাহলে বাঁধ ভাঙত না।
ভান্তি এলাকার বাসিন্দা আবু সালেহ জানান, গোমতীতে আবারও মাটি কাটা শুরু হয়েছে। চর দখল করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা শুরু হয়েছে। এসব যদি এখনই বন্ধ না করা যায়, তাহলে আসছে বছর আবারও বন্যা হবে।
জালুয়াপাড়া এলাকার কৃষক আবদুল মোতালেব বলেন, প্রতিনিয়ত যে যেভাবে পারছে গোমতীর চরের মাটি কাটছে। এই মাটি নেওয়ার জন্য ট্রাক্টর ব্যবহার করছে। ট্রাক্টরের চাকায় ক্ষয়ে গিয়ে বেঁড়িবাধ হুমকির মুখে পরছে। এগুলো দেখার কি কেউ নেই।
এদিকে গোমতীর চরের জায়গা দখল করে কফিশপ তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। পাশাপাশি গোপনীয়তা বজায় রেখে চরের জমি প্রতি শতক ৫০ হাজার কোথাও এক লাখ টাকা দরে বিক্রি করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। তারা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে এসব জমি বেচাকেনা করছে। গোমতী পাড়ের মানুষ বলছে রাজনৈতিক নেতাদের নাম ভাঙিয়ে কখনো ডিসি-ইউএনওর নাম ভাঙিয়ে চলে এসব অপকর্ম। এগুলো রুখতে না পারলে গোমতী নদীর চরের জমি বেহাত হয়ে যাবে।
বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে, যদি পানি উন্নয়ন বোর্ড চায় তাহলে অবশ্যই অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান জানান, গোমতীর বুড়বুড়িয়ায় যেদিকে বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে, সেই বাঁধের প্রায় সিংহভাগ মেরামত করা হয়েছে।
অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কি পরিকল্পনা রয়েছে এমন প্রশ্নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা জানান, অবৈধ স্থাপনার তালিকা করে জেলা প্রশাসনের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও উচ্ছেদের ব্যয়ভার বরাদ্দ পেলে অভিযান শুরু করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়সার জানান, নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নদী রক্ষার ব্যাপারে বেশ সচেতন। প্রত্যেক জেলার একটি করে নদীর নাম চাওয়া হয়েছে যেগুলো থেকে অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করতে হবে। আমরা কুমিল্লা থেকে একটি নদীর নাম পাঠিয়েছি। সেটি হচ্ছে গোমতী নদী। সিএস অনুযায়ী গোমতী নদীর অবৈধ স্থাপনার তালিকা করা হয়েছে ৫৪৫টি। বিএস অনুযায়ী হলে সেই সংখ্যা সহস্রাধিক হবে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ পেলে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।