নথিতে পলকের টাকা দেখে বিস্মিত আদালত
সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মানি লন্ডারিং মামলায় জামিন নাকচ করেছেন আদালত। আজ সোমবার (৬ জানুয়ারি) ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিব এই আদেশ দেন। এর আগে গত ১ জানুয়ারি পলককে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে তদন্ত কর্মকর্তারা। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারক গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। গ্রেপ্তার দেখানোর পরে পলকের পক্ষে তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন।
জামিন আবেদনে পলক বলেন, পলক সাহেব নিয়মিত ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করেছেন। তার সম্পদের সব উৎস সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। তার যে সম্পদ ছিল সেই সম্পদই আসল। তার বাজারমূল্য বেড়েছে। যে কারণে তার মানিলন্ডারিংয়ের যে অভিযোগ তার কোনো উপাদান নেই। এরপরে, দুদকের পক্ষে প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি শুনানিতে বলেন, মানিলন্ডারিং দেশে-বিদেশে যেকোনো জায়গায় হতে পারে। মামলার তদন্ত হয়ে আসুক। তাদের মতো জায়গায় থেকে দুর্নীতি করা, এ অবস্থায় যদি তাদের জামিন দেওয়া হয়। তাহলে অন্যরা উৎসাহিত হবে।
এ সময় বিচারক বলেন, তার (পলক) এতো কম টাকা, সম্পদ তো অনেক কম। পি কে হালদার তো পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। শুনানি করার সময় আপনারা তো বলেন হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি। পরে আদালত তার জামিন নাকচের আদেশ দেন। এরপর তাদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে নাটোর-৩ (সিংড়া) আসন থেকে জয়ী জুনাইদ আহ্মেদ পলক ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। সেখান থেকেই পরেরবার প্রতিমন্ত্রী এবং তারপর ক্ষমতার শীর্ষস্থানে পৌঁছে যান পলক। প্রথমে ধার-দেনা করে নির্বাচন করা পলকের সম্পদ ছিল মাত্র ৩ লাখ ১১ হাজার টাকা। তবে ১৫ বছরে এই সম্পদ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আলাদিনের চেরাগ পাওয়া সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ১৩৮ গুণ, যা ১৩ হাজার ৭৪৫ শতাংশ বৃদ্ধির সমান। গত চারটি নির্বাচনে পলকের দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে তাঁর বৈধভাবে এতো সম্পদ অর্জনের সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দাপুটে এই প্রতিমন্ত্রী গত জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। তখন তাঁর সাফাই বক্তব্য ‘আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, বন্ধ হয়ে গেছে’ ভাইরালও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বর্তমানে একাধিক মামলায় গ্রেপ্তার রয়েছেন পলক। এ কারণে তাঁর কোন বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
পলকের চার বছরের নির্বাচনি হলফনামা অনুসারে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে ধার ও দানের অর্থে নির্বাচন করেছিলেন পলক। তিনি ২০০৮ সালে নির্বাচনি ব্যয়ের জন্য অর্থ প্রাপ্তির উৎস হিসেবে হলফনামায় বলা হয়, মোট চারজন খালাতো ও একজন দুলাভাইয়ের কাছ থেকে পলক ধার করেন আড়াই লাখ টাকা। একই সময় নির্বাচনি ব্যয়ের জন্য আড়াই লাখ টাকা অর্থ দান করেন তাঁর স্ত্রী, তিন খালাতো ভাই, দুই দুলাভাই ও এক চাচা। এ ছাড়া স্থানীয় আরও ১১ জন তাঁকে ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা অর্থ দান করেন। অর্থাৎ তিনি ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা নির্বাচনি ব্যয়ের জন্য ধার করেছিলেন এবং দান হিসেবে অর্থ পেয়েছিলেন। আর পলকের নিজের হাতে ছিল মাত্র ৫০ হাজার টাকা।
১৫ বছরে সম্পদ বাড়ে ১৩ হাজার শতাংশের বেশি
নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে জুনাইদ আহমেদ পলকের মোট ৩ লাখ ১১ হাজার টাকা মূল্যের অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ ছিল। ২০১৩ সালে তাঁর সম্পদ বেড়ে হয় ৬৬ লাখ ৪৩ হাজার ২৬ টাকা। ২০১৮ সালে সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৩২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯২ টাকা। সর্বশেষ, ২০২৩ সালের হলফনামায় সম্পদ দেখানো হয়, ৪ কোটি ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ১৭৭ টাকা।
অর্থাৎ আলাদিনের চেরাগের মতো প্রতি নির্বাচনি বছরে পলকের প্রদর্শিত আয় বেড়েছে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে ২,০৩৬ শতাংশ, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালে বৃদ্ধির হার ছিল ৪০১ শতাংশ, ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বৃদ্ধির হার ছিল ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে তাঁর সম্পদ বৃদ্ধির হার ১৩,৭৪৫ শতাংশ, এ প্রায় অবিশ্বাস্য।
বার্ষিক আয় বাড়ে সাড়ে ৫৫ গুণ
২০০৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী, পলকের বার্ষিক আয় ছিল ৫৮ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে এ আয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ ২ হাজার ৭৫২ টাকা। ২০১৮ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ১৮ লাখ ৪২ হাজার ৪৯ টাকা। তবে, ২০২৩ সালে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ লাখ ২২ হাজার ২৬৮ টাকায়। অর্থাৎ, ২০০৮ সাল থোক ২০২৩ সালে তার আয় বেড়েছে সাড়ে ৫৫ গুণ। এসব আয়ের মধ্যে তিনি চাকরি, কৃষি খাত, বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান ভাড়া, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত খাত থেকে আয়।
সম্পদের চেয়ে ঋণ বেশি পলকের
২০০৮, ২০১৩ ও ২০১৮ সালের হলফনামায় পলকের কোনো ব্যাংক ঋণ ছিল না। ২০২৩ সালের হলফনামায় দেখা যায়, তিনি মধুমতি ব্যাংক থেকে ৫ কোটি ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ১২৪ টাকা ঋণ নেন। অন্যদিকে ২০২৩ সালের হলফনামা অনুযায়ী, তার অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদ ছিল ৪ কোটি ৩০ লাখ ৫৮ হাজার ১৭৭ টাকা।
কৃষি-অকৃষি জমি বেড়েছে, পেয়েছেন পূর্বাচলে ১০ কাঠার প্লট
২০০৮ সালের হলফনামায় পলক ২০ হাজার টাকা মূল্যের এক বিঘা কৃষি জমি থাকা কথা উল্লেখ করেন। তবে, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালের হলফনামায় তিনি ৭ বিঘা ১২ শতাংশ কৃষি জমির হিসাব জমা দেন। যার মূল্য দেখানো হয় ৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
২০০৮ সালে ১৮ শতাংশ অকৃষি জমির মূল্য দেখান ৯০ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে তিনি কেবল ৪ শতাংশ জমির হিসাব দেখালেও দাম জানেন না বলে উল্লেখ করেন। ২০১৮ সালের হলফনামায় তিনি ৪৫ লাখ টাকা মূল্যের পূর্বাচলে রাজাউকের ১০ কাঠার একটি প্লটের কথা উল্লেখ করেন।
পলকের বাড়িতে স্ত্রীর বিনিয়োগ ৫০ লাখ টাকা
২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা যায়, স্বামী পলকের বাড়িতে তাঁর স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকা ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া কনিকার নামে রাজধানী শেওড়াপাড়ায় দুটি দোকান সম্পদ হিসেবে দেখানো হয়, যার মূল্য ৩৬ লাখ টাকা।
পরের নির্বাচনি বছর ২০২৩ সালের হলফনামায় স্ত্রী কনিকার নামে যুক্ত হয় রাজধানী ঢাকা ১৭২০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। তবে সেই ফ্ল্যাটের মূল্য অজানা বলে উল্লেখ করা হয়।
হঠাৎ পলক ও স্ত্রী উপহার পান ১৪৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার
২০০৮ সালে পলকের স্বর্ণ, অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথর নির্মিত কোনো অলঙ্কারাদি না থাকলেও তাঁর স্ত্রীর ছিল ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। অন্যদিকে ২০১৩ সালে পলক ৪১ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উপহার পান, আর তার স্ত্রী পান ১০৩ ভরি। তবে এই স্বর্ণালঙ্কারের দাম জানতেন না পলক ও তাঁর স্ত্রী।
২০১৮ সালেও পলক তাঁর মোট ৪১ ভরি স্বর্ণালংকার থাকার কথা উল্লেখ করেন। তবে এর মধ্যে তিনি ২ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের দাম ১৪ হাজার টাকা উল্লেখ করেন। বাকি ৩৯ ভরির দাম অজানা বলে উল্লেখ করেন। একই সময় স্ত্রী কনিকার স্বর্ণালঙ্কার ১০৩ ভরি থেকে কমে দাঁড়ায় ৬৯ ভরি। তবে এখানেও তিনি দাম জানা নেই বলে উল্লেখ করেন।
২০২৩ সালের হলফনামা পলকের ৩৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উধাও হয়ে যায়। তার কাছে থাকা মাত্র ২ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের দাম দেখানো হয় ১৪ হাজার টাকা। একই সময় স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কারও কমে দাঁড়ায় ৩০ ভরিতে।
কোটি টাকার জিপে চড়তেন পলক, স্ত্রী নিশান এক্স-ট্রেইলে
২০০৮ সালে পলকের কোনো গাড়ি না থাকলেও ২০১৩ সালে ৪৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকার একটি গাড়ির কথা বলা হয়। ২০১৮ সালে দেখা যায়, তিনি চড়তেন ৭০ লাখ টাকার জিপে। আর ২০২৩ সালে পলক চড়তেন ১ কোটি টাকা মূল্যের জিপে।
২০০৮ সালের পলকের স্ত্রী আরিফা জেসমিন কনিকার কোনো গাড়ি না থাকলেও ২০১৩ সালে ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকার ঋণে তিনি গাড়ি কেনেন। আর ২০১৮ সালে ৪৫ লাখ টাকা দামের নিশান এক্স-ট্রেইল গাড়ি থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০২৩ সালে তাঁর স্ত্রীর নামে হলফনামায় কোনো গাড়ি দেখানো হয়নি।
শটগান ও পিস্তল ছিল পলকের
২০০৮ সালে পলকের কোনো অস্ত্র ছিল না। তবে ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালের হলফনামায় তার কাছে থাকা একটি শটগান ও একটি পিস্তলের মূল্য দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা।