কেউ মোনাজাতে কেউ সেজদায়, সবার চোখে আনন্দ অশ্রু
বিনা বেতনে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা। তাদের দীর্ঘদিনের দাবি—প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নিবন্ধনভুক্ত সব স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ করা হোক।
এ দাবি পূরণে বিভিন্ন সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও কখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বরং পুলিশি হামলাসহ নানা ধরনের হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে তাদের।
সর্বশেষ স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৯ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই জাতীয়করণের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। শুরু থেকে এটি অবস্থান কর্মসূচি হিসেবে থাকলেও গত ২৬ জানুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে। এ সময় পুলিশকে শিক্ষকদের ওপর লাঠিপেটা করতে দেখা গেছে। এতে এক নারী শিক্ষকসহ ছয়জন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় জামায়েত ইসলামী, চরমোনাইয়ের পীরসহ অনেক রাজনৈতিক দল নিন্দা জানায়। এরপর ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকাল থেকে আন্দোলনে নামেন ইবতেদায়ি শিক্ষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনের সড়ক। টানা ১০ম দিনের মতো ইবতেদায়ি শিক্ষকদের আন্দোলন চলছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১১টা। শিক্ষকদের মধ্যেও বেশ উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিও আগের দিনগুলোর চেয়ে একটু বেশি।
হঠাৎ করে আন্দোলনরত শিক্ষকদের মধ্য থেকে জানানো হয়, মন্ত্রণালয় থেকে ফোনকল এসেছে, শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দলকে সচিবালয়ে ডাকা হয়েছে।
একটু পরে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের ১৫ সদস্যের একটি দল সচিবালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এরপরই শিক্ষকদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়—আমাদের শিক্ষক প্রতিনিধিরা সচিবালয়ে এখনই মিটিং বসবেন। আপনার সবাই দোয়া ও জিকির করুন।
এ ঘোষণার পর অনেকেই জিকির আর দোয়া করতে শুরু করেন। অনেকে মোনাজাতে কান্নায় চোখ ভেজান। আল্লাহ যেন তাদের চোখের পানি কবুল করলেন। শিক্ষক প্রতিনিধিরা সচিবালয় থেকে জানালেন— আলোচনা ফলপ্রসূ।
সবার মধ্যে টান টান উত্তেজনা। গণমাধ্যমকর্মীরাও অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর আন্দোলনের স্থানে এলেন আন্দোলনকারীদের নেতা। বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহর নিকট লাখো কোটি শুকরিয়া। এর বাইরে তিনি আর কিছুই বললেন না। সাংবাদিকদের প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যা বলার উপদেষ্টা মহোদয়ের প্রতিনিধি আসছেন, তিনিই বলবেন।
এরপর এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মাইক হাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এস এম মাসুদুল হক জানালেন, ইবতেদায়ী শিক্ষকদের ছয় দফা দাবি নীতিগতভাবে গ্রহণ করেছে মন্ত্রণালয়। এটি নিয়ে কাজ চলছে। এর সাথে আরও কিছু বিষয়ও যোগ করা হয়েছে। তার এ ঘোষণার পর শুরু হয় কান্নার রোল, সবার চোখে তখন আনন্দ অশ্রু।
শোকরানা নামাজে দাঁড়িয়ে যান অনেকে, কেউ মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেউ সেজদায় লুটিয়ে পড়েন, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছেন। কেউ আবার মোবাইলফোনে পরিবারকে জানাতে গিয়েও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
পুরো আন্দোলন স্থানের পরিবেশ তখন অন্য এক রূপ নেয়। সবার মুখে হাসি থাকলেও চোখে ছিল অশ্রু ছিল। যেন ২০ বছরের জমে থাকা কষ্ট চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ছে।