জুমার নামাজে মুসল্লিদের ঢল, শনিবার যৌতুকবিহীন বিয়ে
গাজীপুরের টঙ্গীতে তুরাগ নদের তীরে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে।
আজ শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) বাদ ফজর থেকে আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। আগামীকাল শনিবার বাদ আসর ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
এবারও উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে যথারীতি তাবলিগ জামাতের ছয় উসুল কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহীহ নিয়ত ও তাবলীগ বিষয়ে আমবয়ানের মাধ্যমে ইজতেমার প্রথম পর্বের কার্যক্রম শুরু হয়। কোরান হাদিসের আলোকে মুসল্লিদের উদ্দেশে চলবে তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের বয়ান।
মতপার্থক্যের কারণে এবারেও ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম পর্বের নেতৃত্বে থাকছেন জোবায়ের পন্থি আলেম-ওলামা ও অনুসারী মুসল্লিরা। ছয় দিনব্যাপী প্রথম পর্বের ইজতেমা দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ১৪ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা সাদপন্থিদের তিন দিনের ইজতেমা হওয়ার কথা রয়েছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনের কাছে ইজতেমা মাঠ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
ইজতেমার শুরুর দিন শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজে অংশ নিতে ইজতেমাস্থলে মুসল্লিদের ঢল নামে। সকাল থেকেই টঙ্গী ও আশপাশের এলাকার হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ছুটে আসেন টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে। নামাজের আগেই ইজতেমার পুরো প্যান্ডেল ও ময়দান কানায় কানায় ভরে যায়। প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কসহ আশপাশের সড়ক ও গলিগুলোতে যে যেখানে পেরেছেন পাটি, চটের বস্তা, খবরের কাগজ বিছিয়ে জুমার নামাজে শরিক হয়েছেন। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া টঙ্গীর বিভিন্ন উচু ভবনের ছাদেও মুসল্লিরা জুমার নামাজে শরিক হন। জুমার নামাজে ইমামতি করেন বাংলাদেশের মাওলানা হাফেজ মোহাম্মদ জুবায়ের।
নানা বিড়ম্বনাকে উপেক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি আজ ইজতেমা ময়দানে ছুটে আসেন। রবিবার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লিদের এ ঢল অব্যাহত থাকবে। শনিবার বাদ আসর ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশের প্রায় সাত হাজার মুসল্লি উপস্থিত হবেন বলে আশা করছেন ইজতেমার মুরব্বিরা।
বিশ্ব ইজতেমা মাঠের প্রায় দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনির প্যান্ডেলে মুসল্লিদের বয়ান শোনার জন্য লাগানো হয়েছে বিশেষ মাইক। লাগানো হয়েছে পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক বাতিও। এবার ইজতেমা শুরুর দুদিন আগেই ময়দান কানায় কানায় ভরে গেছে।
জোবায়ের অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা মো. হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, সাথীরা সকাল থেকেই স্রোতের মতো আসতে শুরু করেছেন। আশাকরছি এবার রেকর্ডসংখ্যক লোক হবে। বিদেশি মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানের উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থান নিচ্ছেন।
আয়োজক কমিটির মুরব্বিরা জানান, আজ বাদ ফজর উর্দুতে চূড়ান্ত আমবয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক মূল বয়ান শুরু করেন। তার বয়ান বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে শোনান বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান। সকাল পৌনে ১০ টায় খিত্তায় খিত্তায় তালিমের আমল অনুষ্ঠিত হয়। মুসল্লিদের উদ্দেশে তালিমের আগে মোজাকেরা (আলোচনা) করেন ভারতের মাওলানা জামাল। সকাল ১০টায় শিক্ষকদের উদ্দেশে বয়ানের মিম্বরে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ফারাহিম। ছাত্রদের সাথে নামাজের মিম্বারে বয়ান করেন আলিগড়ের প্রফেসর আব্দুল মান্নান। এ ছাড়া খাওয়াছদের (গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ) মাঝে টিনশেড মসজিদে বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আকবর শরিফ। তা চলে দুপুর পর্যন্ত। জুমার নামাজের পর বয়ান করেন জর্ডানের মাওলানা ওমর খতিব। এরপর বাদ আছর বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের এবং বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা আহমদ লাট সাহেব বয়ান করেন। ইজতেমাস্থলের বয়ান মঞ্চ থেকে মূল বয়ান উর্দূতে হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তা তরজমা করা হচ্ছে। পরে তাবলিগ মারকাজের শুরা সদস্য ও বুর্জুগরা ঈমান, আমল ও দাওয়াতের মেহনত সম্পর্কে ফজিলতপূর্ণ সারগর্ভ বয়ান করেন।
আয়োজকরা জানান, এবারের বিশ্ব ইজতেমার কর্মসূচির মধ্যে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ছয় উসুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানোসহ নতুন জামাত তৈরি হবে।
স্বাস্থ্যসেবা
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে স্বাস্থ্য বিভাগ বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এ হাসপাতালে ইজতেমা উপলক্ষে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল মোতায়েন রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও মুসল্লিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে এজতেমা ময়দান ও আশেপাশে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। ওইসব ক্যাম্প থেকে ২৪ ঘণ্টা মুসল্লিদের বিনামূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
কন্ট্রোল রুম
বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের সার্বিক নিরাপত্তা ও মুসল্লিদের খেদমতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বাংলাদেশ পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রের (ডেসকো) পক্ষ থেকে আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান জানান, জুমার নামাজ আদায় করতে আশপাশের জেলার অনেক মুল্লিরা এখানে আসেন। জুমার নামাজ উপলক্ষে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে। যানজটমুক্তভাবে চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ রাখা হয়। ইজতেমার নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন রয়েছে পুরো টঙ্গী ও আশেপাশের এলাকাজুড়ে। ইজতেমা ময়দান ও আশেপাশের এলাকায় ছিনতাই-পকেটমারসহ অপরাধমূলক কার্যকলাপ রুখতে টহল টিম রয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক সিসি ক্যামেরা, আইপি ক্যামেরা ও নাইটভিশন ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য বোম ডিসপোজাল ইউনিট, সোয়াত টিম, ডগ স্কোয়াড, বিস্ফোরক প্রশিক্ষক টিম, নৌবহর ও হেলিকপ্টার দিয়েও টহল দেওয়া হচ্ছে ইজতেমা ময়দান এলাকায়। এ ছাড়া ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে, সাদা পোশাকে এবং ইউনিফর্মে পুলিশ সদস্যরা ইজতেমা ময়দান এলাকায় সার্বক্ষণিক কাজ করছেন।
জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফীন জানান, মুসল্লিদের যাতায়তের জন্য বিশেষ ট্রেন, পর্যাপ্ত বিআরটিসি বাস ও লঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এজন্য পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নিয়োজিত আছেন। পর্যাপ্ত সংখ্যক বিজিবিও প্রস্তুত রয়েছে। দেশের সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ইজতেমা মাঠে মোতায়েন রয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা, বিশুদ্ধ খাবার ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সুষ্ঠুভাবে সমাধানের জন্য একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে প্রতিদিন অন্তত ৩০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।
ইজতেমার মুরব্বিদের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে এই ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে তা স্থানান্তর করা হয়। পরে সরকারিভাবে তুরাগ তীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে ইজতেমা মাঠের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।