বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ শেষ, দ্বিতীয় ধাপ শুরু কাল
টঙ্গীর তুরাগ তীরে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কণ্ঠে ‘আমিন আল্লাহুমা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে আজ রোববার শেষ হয়েছে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ।
আগামীকাল সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) শুরু হচ্ছে এ পর্বের দ্বিতীয় ধাপ। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা জুবায়ের অনুসারী শুরায়ে নেজামির নেতৃত্বে এ পর্বটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ধাপের জন্য ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছেন শুরায়ে নেজামির মুসল্লিরা।
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। মাওলানা সাদ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তাবলিগ অনুসারীরা এ পর্বের ইজতেমায় অংশ নেবেন। তিন দিনব্যাপী এ পর্বের ইজতেমা আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আজ ভোর রাত থেকেই টঙ্গীর ইজতেমা অভিমুখে শুরু হয় বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো মানুষের ঢল। শনিবার মধ্যরাত থেকেই ইজতেমা ময়দানগামী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোটরগাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মোনাজাতে অংশ নিতে শীত ও নানা ঝামেলা উপেক্ষা করে চারদিক থেকে লাখ লাখ মুসল্লি হেঁটেই ইজতেমাস্থলে পৌঁছেন। মোনাজাতের আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হওয়ায় মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলিতে অবস্থান নেয়। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মোনাজাতের জন্য পুরনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন শিট বিছিয়ে বসে পড়ে। বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস-দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদে নৌকায় মুসল্লিরা অবস্থান নেয়। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পরা মানুষ আর মানুষ। ইজতেমাস্থলের চারপাশের চার-পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আখেরি মোনাজাতের জন্য আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস ও প্রতিষ্ঠানে ছিল ছুটি। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে আজ সকালেই ইজতেমা এলাকায় পৌঁছেন।
মাওলানা জুবায়ের মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ তুমি তো ক্ষমাশীল, তোমার কাছেই তো আমরা ক্ষমা চাইব। দ্বীনের ওপর আমাদের চলা সহজ করে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যাও। আমরা যেন তোমার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তৌফিক দাও। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। নবীওয়ালা জিন্দেগি আমাদের নসিব করো। হো আল্লাহ আমাদের ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেন। গোপন গুনাহ, প্রকাশ্য গুনাহ সব গুনাহ মাফ করে দেন। আমরা যেন আপনার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দিন। দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করো। এ বিশাল ময়দানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে যার হাতকে আপনার পছন্দ হয় তার উছিলায় আমাদের সবার মোনাজাত কবুল করে নেন। আমাদের জিন্দিগি গুনাহ মুক্ত হওয়ার তৌফিক দেন।
দুটি ড্রোন দুর্ঘটনা, মুসল্লি আহত
টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমায় আখেরি মোনাজাত চলাকালে পৃথক দুটি ড্রোন দুর্ঘটনার শব্দে আতংকিত হয়ে মুসল্লিদের দিগ্বদিক ছুটোছুটিতে পদদলিত হয়ে, ড্রেন ও রাস্তায় পড়ে প্রায় শতজন মুসল্লি আহত হন। মোনাজাত শেষ হওয়ার ১০ থেকে ১২ মিনিট আগে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এ ঘটনা ঘটে।
মোনাজাতের সময় আকাশে উড়া একটি ড্রোন হঠাৎ ইজতেমা ময়দানের বিদেশি কামরার টিনের চালার উপর আছড়ে পড়ে। টিনের উপর আছড়ে পড়ায় বিকট শব্দ হলে আতংকিত হলে মোনাজাত ফেলে মুসল্লিরা মাঠ ছেড়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে দৌড়াতে থাকেন। এ সময় অনেকেই বলতে থাকে সাদ পন্থীরা হামলা চালিয়েছে সবাই পালাও। মুসল্লিদের এমন দৌড়াদৌড়ি ইজতেমা ময়দান ছাড়িয়ে উত্তরে চেরাগআলী, দক্ষিণে টঙ্গী আবদুল্লাহপুর, পূবে টঙ্গী স্টেশন, পশ্চিমে কামারপাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে গিয়ে অনেকে পদদলিত হন। এতে অর্ধশতাধিক মুসল্লি আহত হন।
অপর ঘটনাটি ঘটে টঙ্গী হাসপাতালের সামনে। এ ড্রোনটি আকাশে উড়ার সময় হঠাৎ নিচে একটি দোকানের বেলুনের উপর আছড়ে পড়ে। ড্রোনটি গ্যাসের খেলনা বেলুনের উপড় আছড়ে পড়লে বিক্রেতার বেলুনগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে থাকে। এতে চতুর্দিকে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় মোনাজাতরত মুসল্লিরা আতংকিত হয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের জন্য দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। এতে প্রায় অর্ধশত মুসল্লি আহত হয়।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি ফরিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ছবি সংগ্রহের জন্য ক্যামেরা সংবলিত ড্রোন দুটি আকাশে উড়ছিল। এ সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বা চার্জ শেষ হয়ে ড্রোনগুলোর একটি ইজতেমা ময়দানের টিনের ছাউনিতে এবং অপরটি টঙ্গী মেডিকেলের সামনের সড়কে গ্যাস বেলুন বিক্রেতার বেলুনের উপর আছড়ে পড়ে শব্দের সৃষ্টি হয়। হঠাৎ এ ঘটনা ঘটায় মুসল্লিরা আতংকিত হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে বেশ কয়েকজন আহত হয়। আহতদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আখেরি মোনাজাতের পর হুড়াহুড়ি করে মুসল্লিরা ময়দান থেকে বের হওয়ার সময় অসাবধানতাবশত ইজতেমার ৪ নং গেটের ভিতরে চায়ের কেটলির গরম পানি পড়ে যায়। এ সময় পানি ছিটকে চার মুসল্লি আহত হন। তাদের মধ্যে মুসল্লি জুয়েলের ডান পায়ে চায়ের কেটলি পড়ে হাঁটুর নিচের অংশ ঝলসে যায়। তাকে উদ্ধার করে টঙ্গীর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
টঙ্গী শহীদ আহসানের মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাকিল বিন সিরাজ জানান, গুরুতর আহত জুয়েলকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের বার্ন ইউনিটে রেফার্ড করা হয়েছে।
প্রথম পর্বে দুই সহস্রাধিক জামাত তৈরি
বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে তাবলিগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমা স্থলে প্রথম পর্বে দুই সহস্রাধিক জামাত তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে দেশীয় জামাত হয়েছে প্রায় দুই হাজার এবং প্রায় ৮০০ বিদেশি জামাত হয়েছে। এসব জামাতে কেউ কেউ এক চিল্লা, দুই চিল্লা, তিন চিল্লা, ছয় চিল্লা ও এক বছরের চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামী ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
বিদেশি মুসল্লি
আজ দুপুর পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চাঁদ, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্থান, খিরগিজস্থান, মালয়েশিয়া, মরক্কো, নেপাল, কেনিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্দান ও দুবাইসহ বিশ্বের ৭৬টি দেশের প্রায় তিন হাজার ৫০ মুসল্লি অংশ নেন।