বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের পালে ঐক্যের সুবাতাস

১৫ বছর স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ পরিচালনার পর ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার পলায়নের পর ৫৩ বছরের বাংলাদেশ–পাকিস্তানের বৈরিতার সম্পর্ক নতুন মোড় নিতে শুরু করে। বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে ওঠে দেশটি। সামরিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা উভয় দেশের। ইতোমধ্যে ৫৩ বছর পর তিন মাসের ব্যবধানে দুটি পণ্যবাহী জাহাজ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জোট সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি বলেও মনে করছে উভয় দেশের নেতারা। এতে এই অঞ্চলের সবগুলো দেশ উপকৃত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এনটিভি অনলাইনের প্রতিনিধিসহ বাংলাদেশের মিডিয়া ডেলিগেশন টিমের সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরকালে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, তথ্য অধিদপ্তর, থিংক ট্যাংক, পাঞ্জাবের স্পিকার, গভর্নরসহ বিশিষ্টজনদের সঙ্গে বৈঠকে এসব তথ্য উঠে আসে।
সংস্কৃতি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক
পাকিস্তানের সংস্কৃতি এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার সঙ্গে ইসলামাবাদ ক্লাবে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আলোচনা করেন। এ সময় তিনি মোবাইল ফোনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর সঙ্গে আলাপ করেন। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক নানা বিষয় আদান প্রদানের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ আরও বৃদ্ধি পাক। এ জন্য সরাসরি ঢাকা টু ইসলামাবাদ বিমান চলাচল শুরুর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সংস্কৃতি বিনিময় জন্য বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ইসলামাবাদের থিং ট্যাঙ্কের সঙ্গে বৈঠক
ইসলাবাবাদ পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউট (আইপিআরআই) এর প্রধান ড. রেজা মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে। এ সম্পর্ক জোরদার করতে পিপল টু পিপল (দু'দেশের জনগণের মধ্যে) যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
আইপিআরআই আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় কাশ্মীরের শিক্ষার্থী মরিয়ম তৈয়ব বলেন, ‘বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবে আমরা অনুপ্রাণিত। আমরা চাই, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হোক। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে তথ্য ও অভিজ্ঞতা আদান প্রদান হোক। অতীতের সব তিক্ততা ভুলে আমরা নতুন প্রজন্ম দু'দেশের সম্পর্ককে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও মর্যদার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে চাই।’
আইপিআরআই এর প্রধান ড. রেজা মাহমুদ বলেন, ‘পাকিস্তান বাংলাদেশের ঠিক প্রতিবেশী রাষ্ট্র না হলেও বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাণিজ্যিক সম্পর্ক একটা বড় দিক। আওয়ামী লীগ আমলেও অবশ্য বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ ছিল না।’ বাংলাদেশে চামড়া, টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতে পাকিস্তানিদের বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তান বাণিজ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের আমদানি তালিকায় রয়েছে—তুলা, কাপড়, বিভিন্ন রাসায়নিক, খনিজ ও ধাতব উপাদান, বৈদ্যুতিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। বাংলাদেশ থেকে পাট ও পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, সিনথেটিক ফাইবার, টেক্সটাইল সামগ্রী, কিছু চিকিৎসায় ব্যবহার্য সামগ্রী রপ্তানি হয় পাকিস্তানে। দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে পাকিস্তানের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও থিং ট্যাঙ্কাররাও অত্যন্ত আশাবাদী। তারা মনে করেন, জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশে এক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এই ইতিবাচক চিন্তাধারা দু'দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

৭১ সালে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য
পাকিস্তান সফরকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন পাকিস্তানের অতিরিক্ত সচিব (এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর বিষয়ক) ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিচতলায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নেতৃত্ব প্রদানকারী সব নেতাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। রয়েছে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং বাংলাদেশের অনেক বীর সেনা কর্মকতাদের ছবি।
অতিরিক্ত সচিব (এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর বিষয়ক) ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধটি তৃতীয় দেশের ষড়যন্ত্রে হয়েছে। দেশ পৃথকে তারাই সুবিধা নিচ্ছে। আমাদের ওই সময়ের নেতারা এ বিষয়ে মনোযোগ দেয়নি। তবে ইতিহাস ধরে রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এখন সময় এসেছে দুটি দেশের উন্নয়নে একত্রে কাজ করার।’
পাকিস্তানের এই অতিরিক্ত সচিব মিডিয়া ডেলিগেশন টিমের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান জানার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি তিনি জানান, পাকিস্তান চাইছে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, অর্থনীতি, সামরিক, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরও নিবিড় হোক। উভয় দেশের সর্ম্পক হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে। এক্ষেত্রে সার্ক বড় ধরনের সেতু বন্ধনের ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন, ‘গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় দেশ নির্মাণ সামগ্রী, খাদ্যপণ্য, তুলা, ওষুধ ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রগুলোয় বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে বার্ষিক বাণিজ্য চারগুণ বৃদ্ধি করতে চায়।’
চিকিৎসা, শিক্ষা, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ভ্রমণ, সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে উভয় দেশের মধ্যে তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠার নমুনা হিসেবে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পণ্যবাহী দুটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম।

চালু হবে ঢাকা-করাচি সরাসরি বিমান চলাচল
ঢাকা থেকে পাকিস্তান যাওয়ার সরাসরি স্থলপথ নেই। বিমানপথেও সরাসরি কোনো ফ্লাইট চালু নেই। যে কারণে বাংলাদেশ থেকে দুবাই বা থাইল্যান্ড ট্রানজিট হয়ে পাকিস্তানে যেতে হয়। তবে সম্প্রতি দুই দেশের আলোচনায় জিন্নাহ ফ্লাইট সরাসরি চালুর চিন্তা করছে সরকার। আগামী দুই মাসের মধ্যে ফ্লাইট চালু হবে।
পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় দেবে ফ্রি স্কলারশিপ
বাণিজ্যের পাশাপাশি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহী পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকার ডিসেম্বরে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সেখানকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিভিন্ন বিষয়ে ৩০০টি সম্পূর্ণ বৃত্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তানে ভ্রমণ করে মারি, তক্ষশিলা, হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলো যেন আরও অনেক বাংলাদেশি দেখতে পারেন, সেজন্য দেশটির সরকার সচেষ্ট থাকার কথা জানিয়েছে।

সেরেনা হোটেলে ডিনার
পাকিস্তানের ফাইভ স্টার হোটেল সেরেনা। ইসলামাবাদের সবচেয়ে সুন্দর হোটেল। দেখতে অনেকটা রাজপ্রাসাদের মতো। এ হোটেলেই পাকিস্তান সফররত বাংলাদেশি সাংবাদিকদের জন্য ডিনারের আয়োজন করে দেশটির তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব আম্বরিন জানের সঙ্গে বাংলাদেশের মিডিয়া প্রতিনিধিদের মতবিনিময় হয়।
অনুষ্ঠানে সচিব আম্বরিন জানে বলেন, উভয় দেশেরই বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংযোগ, মিডিয়া, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। দুই দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধার জন্য পাকিস্তান এ অঞ্চলে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ চেতনায় সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলো বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য এবং ভুল ধারণাগুলো প্রতিরোধ করার জন্য মিডিয়া সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।
পাকিস্তানের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বহিরাগত প্রচার শাখার (এক্সটার্নাল পাবলিসিটি উইংস) মহাপরিচালক রাইসা আদিল বলেন, ‘আমি প্রায়ই ভাবি, আমাদের শেয়ার করা সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে প্রকল্প আকারে নিয়ে কাজ করতে পারি।’
রাইসা আদিল বলেন, ‘ডিজিটাল মিডিয়ার উত্থানের এই সময়ে অনলাইনেও আমরা কনটেন্ট শেয়ার, যৌথ ডিজিটাল প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থবহ পরিবর্তন আনতে পারি এবং দুই দেশের মধ্যে ব্যবধান কমাতে পারি।’
এ সময় পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।