গোপালগঞ্জের এসিকাণ্ডে ওসি প্রত্যাহার, তদন্ত কমিটি গঠন

মামলার ভয় দেখিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের কাছ থেকে নগদ টাকা ও এয়ার কন্ডিশন (এসি) নেওয়ার কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনায় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিউদ্দিন খানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আজ সোমবার (৭ এপ্রিল) গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবু সালেহ মো. আনসার উদ্দিনকে তদন্ত করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানোর পর গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার ওসি শফিউদ্দিনকে এসি কিনে দেওয়ার আড়াই মিনিটের একটি কলরেকর্ড ফাঁস হয় শনিবার (৫ এপ্রিল)। ওসি ও ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেনের মুঠোফোনে কথপোকথনের ওই অডিও রেকর্ডটি মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আড়াই মিনিটের ওই কল রেকর্ড থেকে জানা গেছে, কাশিয়ানী থানার ওসি মো. শফিউদ্দিন খান কাশিয়ানী সদর ইউনিয়নের বরাশুর এলাকার ৮নম্বর ইউপি সদস্য জাকির হোসেনের কাছ থেকে শার্প অথবা এনার্জি প্যাক ব্র্যান্ডের দুই টনের একটি এসি কিনে দেওয়ার কথা বলেন। এ সময় জাকিরের কাছে নগদ টাকা না থাকায় তিনি গোপালগঞ্জ থেকে কিস্তিতে কিনে দেওয়ার কথা বলেন। গোপালগঞ্জে না পাওয়া গেলে ঢাকা থেকে কিনে এনে দিতে বলেন ওসি।
এলজি-বাটার ফ্লাই কোম্পানির গোপালগঞ্জ শোরুমের মেমো থেকে জানা গেছে, গত ২৩ মার্চ জাকির নিজ নামে ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়ে কিস্তির মাধ্যমে এলজি ব্র্যান্ডের একটি এসি কেনেন।
ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘কাশিয়ানী থানায় ওসি হিসেবে যোগদানের পর থেকে অসংখ্যবার শফিউদ্দিন খান আমাকে তার এক এসআই আমিনুল ইসলামসহ বিভিন্ন মানুষ দিয়ে এমনকি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মামলার হুমকি দিতেন। এসআই আমিনুল ইসলাম আমাকে বলেন, সামনে বিপদ আছে আপনার। আমি বলি, আমার অপরাধ কী? আমার নামে তো কোনো মামলা নেই, কোনো অভিযোগও নেই। তিনি বলেন, আ’লীগ করেছেন, তাদের সাথে মেলামেশা করেছেন এটাই সমস্যা। আমি জানাই, আমি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ কাশিয়ানী উপজেলা শাখার সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে দল করি। পরে এসআই আমিনুল আমাকে ওসির সঙ্গে দেখা করতে বলেন। সঙ্গে কিছু টাকাও দিয়ে আসতে বলেন, যাতে আমার কোনো সমস্যা না হয়, কোনো মামলায় জড়ানো না হয়।’
ইউপি সদস্য বলেন, “এসআই আমিনুলের মাধ্যমে প্রথম দফায় ৫০ হাজার টাকা ওসিকে দিয়েছি। এরপর মাঝেমধ্যেই ওসি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে বলেন— ‘খুব সমস্যার ভেতরে আছি, কিছু টাকা লাগবে।’ এভাবে আমার কাছ থেকে পাঁচ দফায় প্রায় দুই লাখ টাকা ও এসি নেন। আমার ছোট ছোট চারটি বাচ্চা রয়েছে, তার জন্য জেল খাটার ভয়ে ওসিকে টাকা দিয়েছি। এতেই ক্ষান্ত হননি ওসি, মাঝেমধ্যে তাকে কাশিয়ানীর গোপালপুর, ভাটিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন স্থান থেকে চার দফা মাছও কিনে দিতে হয়েছে।”
জাকির হোসেন আরও বলেন, “গত ১৬ মার্চ আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ার তায়েবা হোটেলে দেখা করতে বলেন। সেখানে গেলে তিনি দুই টনের একটা এসি কিনে দিতে বলেন। আমার আর্থিক সমস্যার কথা জানালে ওসি বলেন, “আমি আপনাকে কত সাহায্য করি, আপনার নামে অনেকে অনেক কথা বলেছে; সেগুলো সেভ করে রেখেছি। যা হোক চেষ্টা করে কিনে দেন।”
জাকির বলেন, ‘আমাকে ২২ মার্চের ভেতরে এসি দেওয়ার জন্য বলেন। আমার সামর্থ্য না থাকলেও ভয়ে দিতে রাজি হই। ২৩ মার্চ ওসিকে কিস্তির মাধ্যমে একটি এসি কিনে দিই। ওসি নিজে কাশিয়ানী থানার পুলিশের গাড়ি নিয়ে গোপালগঞ্জ এলজি অফিসে এসে এসি নিয়ে যান। এ সময় তিনি পাঞ্জাবি পরিহিত ছিলেন।’
কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়ার সাবেক ইউপি সদস্য হান্নান সরদার বলেন, ‘আমি ভাটিয়াপাড়া হাট ইজারার টেন্ডারের জন্য ২৩ মার্চ দরপত্র কিনি। এ খবর পেয়ে ওসি মো. শফিউদ্দিন খান আমাকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বলেন। এরপর আমি গা ঢাকা দেই। পরে ভাটিয়াপাড়া মন্দিরের ভেতরে গিয়ে নগদ এক লাখ টাকা ওসিকে দিতে বাধ্য হই।’ হান্নান সরদার আরও বলেন, খোকন কাজীসহ অসংখ্য লোকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবু সালেহ মো. আনসার উদ্দিন বলেন, ‘ওসির ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি তদন্তের কাজে নেমেছি। পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমানের নির্দেশে তদন্ত করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলব। প্রমাণ পেলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান আজ মুঠোফোনে জানান, ‘রোববার দুপুরে কাশিয়ানী থানার ও মো. শফিউদ্দিন খানকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আবু সালেহ মো. আনসার উদ্দিনকে তদন্ত করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’