৫০০ বছরের প্রাচীন গোরক্ষনাথ মন্দির হারাতে বসেছে ঐতিহ্য

ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার ৫০০ বছরের পুরাতন ও ইতিহাসসমৃদ্ধ গোরক্ষনাথ গোরকই মন্দির অবহেলা আর অযত্নে হারাতে বসেছে তার প্রাচীন ঐতিহ্য। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় সময়ই হারিয়ে যাচ্ছে দামি পাথর বা মূর্তি।
রাণীশংকৈল উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার উত্তরে নেকমরদ ইউনিয়নের গোরকই নামক গ্রামে মন্দিরটি অবস্থিত। সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের তীর্থস্থান হিসেবে দেশের মানুষের কাছে এ মন্দিরটি পরিচিত। মন্দিরের সঙ্গে মিশে আছে অনেক ইতিহাস ও অলৌকিক ঘটনা। মন্দিরের মোট জমির পরিমাণ ছিল ৮৪ একর। বর্তমানে মন্দিরের দখলে আছে মাত্র ৮ একর জমি। এর মধ্যে মন্দির চত্বর, একটি নাথ আশ্রম, কিছু আবাদি জমি, একটি বাগান ও একটি বড় পুকুর। বাকি জমি স্থানীয় কিছু মানুষের দখলে যা মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বেদখল হয়ে আছে।
মন্দিরে রয়েছে তিনটি শিব মন্দির, একটি কালি মন্দির ও একটি নাথ মন্দির। মন্দিরের দক্ষিণ পাশে দুজন পূজারীর সমাধি রয়েছে। লোকনাথ মন্দিরটি ঠিক চত্বরের মাঝখানে অবস্থিত। মন্দিরের পেছনেই রয়েছে অলৌকিক গোরক্ষনাথ গোরকই কূপ বা ইঁদারা। কূপের একেবারে নিচু অংশটুকু পর্যন্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো। কূপটি বড় বড় কালো পাথরের খণ্ড দ্বারা নির্মিত। কূপের পূর্বদিকে একটি দরজা এবং পশ্চিম দিকে একটি দরজা রয়েছে। ওই দরজা দিয়ে আগত ভক্তরা কূপের পানি দিয়ে পুণ্যস্নান করে থাকে। হাজারো সনাতন ধর্মের নরনারী পুণ্যস্নান করার পরও ওই কূপের পানি এক ইঞ্চিও কমে না বলে কথিত আছে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের অমাবস্যায় শিব চতুর্দশী উপলক্ষে এই মন্দিরে তিন থেকে সাত দিনব্যাপী মেলা বসে। এই মেলাকে ঘিরে উপস্থিত হয় হাজার হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের লোকজন। স্থানীয়ভাবে এই মেলাকে বারুনী বা গোরকই মেলা বলে।
এলাকার শিক্ষক তরণী বর্মণ জানান, হাজার হাজার নারী পুরুষ স্নান করার পরও এ কূপের পানি এক ইঞ্চিও কমে না। যা কূপের অলৌকিক বৈশিষ্ট্য মনে করা হয়। মন্দিরটিতে গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। যে পাথরের নমুনাবিশেষ বর্তমানে দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মন্দিরের উত্তর চত্বরে টিনের চাল বিশিষ্ট যে আশ্রম রয়েছে তার দরজায় একটি শিলালিপি বা ফলক ছিল। এই শিলালিপিটি বর্তমানে দিনাজপুর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আবু তালিবের মতে, এই শিলালিপিটি বাংলা অক্ষরে উৎকীর্ণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত শিলালিপিগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম। এছাড়া মন্দিরের পাশেই অবস্থিত একটি বড় পুকুর রয়েছে, সেই পুকুরের চার পাশে পানিতে অনেক কালো রঙের পাথর ছিল। যার মধ্যে অনেক গুলোই হারিয়ে গেছে। মন্দির চত্বরে অবস্থিত সবচেয়ে বড় শিব মন্দিরটি ঠাকুরগাঁও জেলার সবচেয়ে বড় মন্দির হিসেবে ঐতিহ্য বহন করছে। যেখানে প্রতিদিন অনেকে শিবপূজা করতে আসে বলে স্থানীয়রা জানান।
কথিত আছে, গোরক্ষনাথ ছিলেন নাথপন্থীদের ধর্মীয় নেতা মীননাথের শিষ্য। মন্দির কমিটির সভাপতি শীষনাথ, সদস্য চরিত্র কুমার রায় ও পূজারি ভজেন চন্দ্র বলেন, ইতোমধ্যে এই মন্দিরের অনেক মূল্যবান কালো পাথর ও মূর্তি চুরি হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও কূপের দেওয়াল থেকে একটি রাধা কৃষ্ণের মূর্তি চুরি হয়ে গেছে।
মন্দিরটির সামনের দোকানদার সত্যজিত রায় জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে মন্দিরে আসা দর্শনার্থীরা মন্দিরের বেহাল দশা দেখে চলে যান। বসার, খাওয়ার স্থান নেই, এমনকি নেই যাতায়াতের জন্য তেমন কোনো ভালো রাস্তা। খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে আসতে মানুষের ভীষণ কষ্ট হয়।

রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক প্রশান্ত বসাক বলেন, বছরে যখন একবার মেলা বসে তখন মন্দিরটি সুরক্ষিত ও প্রাণোবন্ত থাকে। বাকি দিনগুলিতে আর তেমন তদারকি বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। মন্দিরটি ৫০০ বছরের প্রাচীন, তাই এটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মন্দির কমিটি ও স্থানীয় প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
রানীশংকৈল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাফিউল মাজলুবিন বলেন, যেহেতু এটা অনেক পুরাতন মন্দির তাই জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য সহযোগিতা চাওয়া হবে।