খনিজ-সমৃদ্ধ দেশে যুদ্ধের শঙ্কা শতগুণ
ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদ, বাস্তববাদী আর নব্য রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন- তেল বিদেশি হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। তাঁদের এই বিশ্বাসকে এবার সমর্থন দিল ব্রিটেনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা।
ওয়ারউইক, পোর্টসমাউথ ও এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতদের করা ওই গবেষণায় দেখা গেছে, খনিজ সম্পদ-সমৃদ্ধ দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রবণতা বা শঙ্কা শতগুণ বেশি। নিয়মতান্ত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, প্রধানত অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে বিদেশি হস্তক্ষেপ ঘটে।
আজ শুক্রবার ব্রিটেনের দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটেনের পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও লেখক ড. পেট্রোস সেকারিস বলেছেন, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ‘স্পষ্ট প্রমাণ বের করেছেন যে, তেল উৎপাদনের জন্য সম্ভাবনাময় দেশে যদি গৃহযুদ্ধ লেগে যায়, তবে সে দেশে বিদেশি হস্তক্ষেপ হয় বেশি।’
ড. পেট্রোস আরো বলেন, ‘সামরিক হস্তক্ষেপ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কোনো দেশ নিজের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সেই ব্যয়ের সামঞ্জস্য ছাড়া অন্য দেশের গৃহযুদ্ধে জড়ায় না।’
১৯৪৫ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ৬৯টি গৃহযুদ্ধের তথ্য উদ্ঘাটন ও পর্যালোচনার মাধ্যমে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঘটা সব সামরিক সংঘাতের ৯০ ভাগই গৃহযুদ্ধ। আর এগুলোর প্রায় ৬৭ শতাংশই সংঘটিত হয়েছে বিদেশি হস্তক্ষেপে।
গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তেলই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রভাবক। এর কারণেই লিবিয়া এবং কথিত ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে পশ্চিমারা।
ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. ভিনসেনজো বোভে বলেন, আইএস জঙ্গিরা ইরাকের উত্তরাঞ্চলের তেল-সমৃদ্ধ কুর্দি এলাকা দখলের আগে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু তারা যখন সিরিয়ার কোবানির তেলক্ষেত্র দখল করল তখন পশ্চিমা মিডিয়ার শিরোনামে চলে এলো।
বিভিন্ন দেশে তৃতীয়পক্ষের হস্তক্ষেপের ইতিহাস কয়েক দফা পর্যালোচনার মাধ্যমে খুবই সতর্কতার সঙ্গে একাধিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন গবেষকরা। দেখা গেছে, কোনো দেশের সঙ্গে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত বন্ধনের চেয়েও খনিজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণে বেশি আগ্রহ ছিল তৃতীয়পক্ষের। এ লক্ষ্যেই উপসাগরীয় তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলোতে দীর্ঘসময় ধরে মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। আর গণতন্ত্রের কথা বললেও এসব দেশের স্বৈরশাসকদের পাশে থেকেছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেলের দাম নিম্নগামী থাকায় মার্কিন হস্তক্ষেপ কিছুটা শিথিল হয়েছে বলে কোনো কোনো বিশ্লেষকের দাবি।
ব্রিটেনেরও বিদেশি হস্তক্ষেপের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। যদি কখনো কারো অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন হয়েছে সেখানে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে নেমে পড়েছে। ১৯৬৭ ও ১৯৭০ সালে ব্রিটেন নাইজেরিয়ায় এমন হস্তক্ষেপ করে। কারণ তেলসমৃদ্ধ নাইজেরিয়ার ওপর ব্রিটিশরা অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। একই উদ্দেশ্যে তারা ২০০৩ সালে ইরাককেও আক্রান্ত করে। এরপর ২০১১ সালে স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফি শাসিত লিবিয়াকে আক্রান্ত করে পশ্চিমা জোট।
কিন্তু ততটা তেল উৎপাদনকারী দেশ না হওয়ায় সিয়েরা লিওন ও সিরিয়ায় পশ্চিমারা তাদের আগ্রহ কমিয়েছে। কারণ সামরিক হস্তক্ষেপে খরচের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিল তারা।
পশ্চিমারা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ খাড়া করে সীমিত আলোচনার সুযোগ রেখেই বিভিন্ন দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এতে পশ্চিমা জোটে থাকা দেশগুলোর অভিজাত শ্রেণীই বেশি লাভবান হয়েছে।
তবে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি হস্তক্ষেপে চীন নেতৃত্ব দিতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যবান সম্পদের নিয়ন্ত্রণ, গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চলে প্রভাব তৈরি, লাভজনক অস্ত্রশিল্পের বিকাশ, শত্রু রাষ্ট্রকে আতঙ্কে রাখা এবং আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিদেশি হস্তক্ষেপের মূল কারণ।