রাজনৈতিক হাঙ্গামার যন্ত্রণা টের পাচ্ছে অর্থনীতি
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এখন পর্যটকশূন্য। পাশের সারি সারি আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো খালি পড়ে আছে। বেপরোয়া হকারদের কপালে পড়েছে হাত। এটি পর্যট্ন শহর কক্সবাজারের হালচিত্র।
অতি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের এমন চিত্র উঠে এসেছে আজ বৃহস্পতিবার ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে।
হোটেল দ্য কক্স টুডের এক কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, ‘আমাদের রক্ত ঝড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে কর্মীদের ছাটাই করতে বাধ্য হব।’
টানা অবরোধ-হরতালের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্য খাতগুলোর মতো পর্যটন শিল্পকে ব্যাপক মূল্য দিতে হচ্ছে। সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটায় চাষিরা বড় ভোগান্তিতে পড়েছে। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক সংহিসতার কারণে ছুটির দিনেও ভ্রমণে আগ্রহ নেই কারো।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে দেশের তৈরি পোশাকশিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। অবরোধের এ কয়দিনে সরবরাহ বন্ধ থাকায় এ খাতের উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সরকার বিরোধীদের সভা-সমাবেশ নিষদ্ধ করায় গত ৫ জানুয়ারি থেকে অবরোধ শুরু হয়। যতক্ষণ না শেখ হাসিনার সরকারের পতন হচ্ছে, ততক্ষণ অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে সরকারবিরোধী জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
সহিংসতা এখন বিক্ষিপ্ত রূপ নিয়েছে। গত মঙ্গলবার বাসে আগুন দেওয়ায় দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে সাতজনের। তারা কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফিরছিল।
৫ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৪ জনেরই মৃত্যু হয়েছে দগ্ধ হয়ে।
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের পর্যটক মৌসুম। এ সময়ে অন্তত সাত লাখ দর্শনার্থীর ভিড় থাকে এখানে। তবে আজ বৃহস্পতিবারও হোটেল দ্য কক্সের ১৯০টির মধ্যে মাত্র ১০টির মতো রুম ভাড়া হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন জানিয়েছেন।
ট্যুরিজম ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জানিয়েছে, চলমান অবরোধ-হরতালে দেশের ভ্রমণ ও সেবা খাতের দৈনিক ২০০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।
কক্সবাজার হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবুল কাশেম বলেন, ‘মানুষ নিজের নিরাপত্তার কথা আগে ভাবছে। একদিন ছুটি পেয়ে কে এই সময় এখানে আসবে?’
লোকসান থেকে রেহাই পেতে স্থানীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১০ হাজার কর্মী ছাটাই হয়েছে বলে জানান আবুল কাশেম।
এ পরিস্থিতি শুধু পর্যটন ও সেবা খাতেরই নয়, অন্য খাতেও একই দশা। গত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হারে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপরই ভরটা পড়েছে বেশি।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। চার হাজারের বেশি পোশাক কারখানা রয়েছে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৪০ লাখ মানুষ, যার বেশির ভাগই নারী।
চলমান রাজনৈতিক সংহিংসতায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। কোনো ট্রাক সেখানে পৌঁছুতে পারছে না। এতে বার্ষিক এক লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকার আয়ের পোশাকশিল্প খাত বড় ধরনের ক্ষতি গুনছে। ঢাকাভিত্তিক বিভিন্ন পোশাক কারখানার মালিককে অতিরিক্ত খরচ দিয়ে বিমানযোগে চট্টগ্রামে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড এক্সপোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিটি কারখানাকে এ সময় বড় ধরনের ক্ষতি গুনতে হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
বিজিএমইএর ভাইস-প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, এ মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পোশাকের ক্রয়াদেশ আসে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ওপর থেকে আস্থা হারাবে।
বাংলাদেশের থিংক ট্যাংক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বলেন, স্বল্প সময়ের জন্য উৎপাদন ও বণ্টন ব্যাহত হলেও বিনিয়োগ ব্যাঘাত পাবে দীর্ঘ সময়র জন্য। সরবরাহ ব্যাঘাত পাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়েছে। আর রপ্তানি শ্লথ হয়ে পড়ায় বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়বে দেশ। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত হতাশা থেকেই যাবে।