রাক্ষসপুরী
এক গ্রামের এক মোড়লের ছয় ছেলে ছিল। ধীরে ধীরে ছেলেরা বড় হয়ে উঠলে মোড়ল ছয় ছেলেকেই একসঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দিল। ছয় বউয়ের মনে সুখ নেই। তারা মনের মতো শাশুড়ি পায়নি। উঠতে-বসতে কথা শুনতে হতো।
এ দুঃখে ছয় বউ সবার আড়ালে চোখের জল ফেলত। সারা দিনে একবার মাত্র খাবার জুটত। বেশির ভাগ দিনই তারা অভুক্ত থাকত। স্বামীকে যে বলবে, তারও কোনো উপায় ছিল না। ছেলেরা আবার মায়ের ভীষণ ভক্ত ছিল।
একদিন গ্রামের অন্য এক মোড়লের বিয়েতে তাদের সবারই নেমন্তন্ন ছিল। সন্ধ্যাবেলা ছয় বউ শাশুড়ির সঙ্গেই বিয়েবাড়িতে গেল। খাবার সময় শাশুড়ি চিৎকার করে ছয় বউকে ডেকে বলল, ওগো, তোমরা শালপাতা নিয়ে এসো, তোমাদের খাবার দিই।
শাশুড়ির কথা শুনে তারা নিরাশ হয়ে গেল। এখানেও রান্নার তদারকি শাশুড়ির ওপর। মনের দুঃখে ছয় বউ ঠিক করল, তারা আর এখানে থাকবে না। দুই চোখ যেদিকে যায়, তারা চলে যাবে। ছয় বউ ছটা কলসি নিয়ে জল আনতে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পড়ল। উদ্দেশ্যহীন পথে তারা হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেল গভীর জঙ্গলে। জঙ্গলের খানিকটা পথ অতিক্রম করার পর দেখতে পেল বিশাল এক অট্টালিকা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা অবাক হয়ে গেল, ভাবল, এই জনশূন্য জঙ্গলে এতবড় অট্টালিকা কোথা থেকে এলো?
সাহস করে তারা অট্টালিকার ভেতরে ঢুকল। সারি সারি ঘর। থরে থরে সাজানা রয়েছে নানা রকম ভালো ভালো খাবার। বস্তায় বস্তায় মোহর, এত সব দেখে ছয় বউয়ের মাথা ঘুরে গেল। অনাহারে পথশ্রমে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই বেশি চিন্তা না করে পেটপুরে খাবার খেয়ে ছয় বউ ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল, গত রাতে যা যা দেখেছিল, সেভাবে আছে। কিন্তু কোনো মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ছয় বউ নিশ্চিন্ত হয়ে সেই অট্টালিকায় বাস করতে লাগল। সারা দিন অট্টালিকার ভেতরেই কাটায়, যখন পুকুরে যায় তখন পালা করে এক বউকে বাড়ি পাহারার জন্য রেখে যায়। একদিন ছোট বউ বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আর পাঁচ বউ স্নান সারতে গেল। ছোট বউ ঘরে বসে ভাবছে। এতদিন হলো এই অট্টালিকায় তারা বাস করছে, অট্টালিকার সব ঘর ঘুরে দেখা হয়নি। ছোট তখন ঘুরে ঘুরে অন্যান্য ঘর দেখতে লাগল। একটা ঘরের সামনে এসে ছোট বউ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। খাটে শুয়ে আছে দু-আড়াই বছরের এক শিশু। আর খাটের নিচে কানাভাঙা একটা কলসি।
শিশুটি বিকৃত গলায় বলল, ও কানা বুড়ি আর কত দিন? আমি যে আর সইতে পারছি না।
কানাভাঙা কলসি সামান্য নড়ে ফিকফিক করে হেসে বলল, যে সয় সে রয়। এখনো যে শুধু হাড় বাছা, খেয়েদেয়ে একটু মোটাসোটা হোক।
এ কথা শুনে ছোট বউ আঁতকে উঠল। সন্তর্পণে সেই স্থান ত্যাগ করে ঘরে ফিরে হাঁপাতে লাগল। কী সর্বনাশ। এরা মায়াবী না হয়ে যায় না, শেষ পর্যন্ত বোধ হয় প্রাণটাই এদের হাত দিতে হবে। বড় পাঁচ বউ স্নান সেরে এলে ছোট বউ তাদের সবকিছু খুলে বলল। প্রথমে তারা বিশ্বাস করেনি। বলল, তোর নিশ্চয়ই ঘুম পেয়েছিল ছোট। ঘুমের ঘোরে আজেবাজে স্বপ্ন দেখেছিস।
কিন্তু পরে তাদের ধারণা পাল্টে গেল। এক এক করে পাঁচজনে যখন তাদের কথা শুনল, তখন তারা ভাবল এ বাড়ি রাক্ষসদের না হয়ে যায় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি থেকে যে করেই হোক পালাতে হবে। ছয় বউ পালানোর ফন্দি আঁটতে লাগল। একদিন সকালে বড় বউ চিৎকার করে বলল, কাল নীল পুজো, চলো আমরা সবাই মাথা ঘষে আসি ।
ছোট বউ বলল, দিদি, বাড়ি ফাঁকা রেখে যাব?
তাতে কী হয়েছে, এখানে তো আর কোনো লোকজন নেই।
ও কিছু হবে না। সবাই চলো দিন থাকতে থাকতে ফিরে এসে উনুনে আঁচ দিতে হবে।
এই বলে তারা কলসি ভর্তি করে মোহর নিয়ে অট্টালিকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। হাঁটছে আর পেছন ফিরে তাকাচ্ছে, পাছে যদি রাক্ষসরা তাদের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা টের পায়।
একসময় হাঁটতে হাঁটতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ছোট বউ ব্যস্ত হয়ে বলল, দিদি সন্ধ্যা তো হয়ে এলো, রাতে কোথায় থাকব? কয়েক পা এগিয়ে তারা দেখতে পেল একটি অশ্বত্থ গাছ। অশ্বত্থ গাছ খুব জাগ্রত হয়। বড় বউ গাছের সামনে গিয়ে বলল, হে বৃক্ষদেবতা বড় বিপদে পড়েছি। রাতটুকুর জন্য যদি আশ্রয় না দাও, তবে রাক্ষসদল আমাদের আস্ত রাখবে না।
দৈববাণী শোনা গেল। আমি গাছের গোড়া দুই ভাগ করছি, তার মধ্যে তোমরা প্রবেশ করে রাতটুকু কাটিয়ে দাও। আগামীকাল সূর্য ওঠার আগে তোমরা আমাকে মুক্তি দিও।
এদিকে অন্ধকার নেমে আসা সত্ত্বেও যখন ছয় বউ স্নান সেরে ফিরে এলো না, রাক্ষসরা বুঝে গেল, তাদের ঠকিয়েছে; সমস্ত রাক্ষস মিলিত হয়ে খুঁজতে লাগল। একসময় তারা পৌঁছে গেল অশ্বত্থ গাছের তলায়। সেখানে এসে মানুষের গন্ধ পেল।
রাক্ষসদের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত প্রবীণ সে বলল, হাউ মাও খাও মানুষের গন্ধ পাউ। এই বলে অশ্বত্থ গাছের ডাল ভাঙতে লাগল। পাতা ছিঁড়তে লাগল। গোটা রাত দাপিয়ে শেষ পর্যন্ত নিরাশ হয়ে অন্ধকার থাকতে থাকতে তারা ফিরে গেল। ভোরবেলায় দৈববাণী ভেসে এলো, ‘তোমরা এখন বিপদ থেকে মুক্ত, বেরিয়ে এসো।’ ছয় বউ বেরিয়ে এসে দেখল, রাক্ষসগুলো রাগে গাছের ছালবাকল তুলে নিয়েছে। ওদের খুব কষ্ট হলো, ওরা পুকুর থেকে কাদামাটি এনে গাছের সর্বাঙ্গে ভালো করে লেপে দিল। বৃক্ষ দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে বলল, তোমাদের ওপর আমি খুশি হয়েছি। তোমরা এক্ষুনি এই জঙ্গল পরিত্যাগ করে উত্তর দিকের জঙ্গলে চলে যাও। রাক্ষস দল কিন্তু আবার আসবে। তোমাদের কাছে অনেক অর্থ আছে, সেই অর্থ সৎ কাজে লাগাও, সুখে-শান্তিতে সেখানে বসবাস করো।
ছয় বউ বৃক্ষদেবতার অনুমতি নিয়ে উত্তরের পথে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছে গেল বৃক্ষদেবতার বর্ণিত স্থানে। সেখানে থাকার জন্য একটি বাড়ি বানাল। ছয় বউ মিলেমিশে জমিতে চাষ-আবাদ করতে লাগল। এইভাবে কেটে গেল বেশ কয়েক বছর।
এখন আর আগের জঙ্গলকে চেনার উপয় নেই।
জঙ্গল কেটে অনেক ঘরবাড়ি হয়েছে, চাষের জমি হয়েছে। সবাই ছয় বউয়ের অধীনে থেকে কাজকর্ম করে। লোকে বলে ছয় রানির জঙ্গলে আমরা খুশি, সুখে-শান্তিতে আছি। এদিকে ছয় বউ চলে যাওয়ার পর থেকে গ্রামের মোড়লের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগল। মোড়ল গিন্নি আর কাজ করতে পারে না। জমি যা ছিল, বিক্রি করে দিয়েছে, ছয় ছেলে বেকার।
অতিকষ্টে দিনমজুর খেটে দুমুঠো খাবার কোনোরকমে জোগাড় করে। শাশুড়ি এখন নিজের কপাল চাপড়ায় আর বলে, আমার জন্য আজ সংসারের এই হাল! বউগুলোকে তাড়িয়েছি। এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে।
এদিকে উত্তরের জঙ্গলে একটি পুকুর খনন করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ছয় বউ চিন্তা করে দেখল, তাদের হেফাজতে যে কজন লোক আছে, তাদের দিয়ে খনন করলে পাঁচ বছর লাগবে। তখন তারা ঢেড়া পিটিয়ে ঘোষণা করে দিল, পুকুর খনন করার জন্য কর্মঠ ব্যক্তিদের কাজে নেওয়া হবে।
পারিশ্রমিকের লোভে মোড়ল, তার বউ আর ছয় ছেলে উত্তরের জঙ্গলে খননকার্যে যোগদান করল। একদিন ছোট বউ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পান চিবোচ্ছিল। পুকুর কাটার দিকে লক্ষ করতে তার শ্বশুর ও শাশুড়িকে দেখতে পেল। দূর থেকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে, তাই ডেকে পাঠাল বাকি পাঁচ বউকে।
পাঁচ বউ দেখে চোখ গোল গোল করে বলল, ও মা, তাই তো, কিন্তু এদের এই দশা হল কী করে? মেজ বউ ঝুড়ি মাথায় ছয় যুবককে দেখিয়ে বলল, দিদি, ওই দেখো ছয় ভাই মাথায় ঝুড়ি করে মাটি তুলছে। সঙ্গে সঙ্গে ছয় বউ দাসীদের পাঠিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি আর স্বামীদের ডেকে পাঠাল। সুসজ্জিত ঘরে বসতে দিল।
আড়াল থেকে বড় বউ দাসীদের উদ্দেশ করে বলল, এদের স্নান করার ব্যবস্থা করে দাও। দাসীরা তাদের স্নানাগারে নিয়ে গেল। স্নান সেরে তারা যখন ঘরে ফিরল তখন দেখল, আটটি আসন পাতা, সামনে রয়েছে নানা রকম সুখাদ্য। এইসব দেখে মনে মনে ভাবল, নিশ্চয়ই খাওয়ার পর তাদের বলি দিয়ে রক্ত দিয়ে পুকুরপুজো হবে। হাউ মাউ করে তারা কেঁদে উঠল। ছোট বউ পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছিল, কাঁদতে দেখে বলল, আপনারা কাঁদছেন কেন?
শ্বশুর হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাদের ছেড়ে দাও, আমরা কারো কোনো ক্ষতি করিনি। আপনার ছয় ছেলে বউ কোথায়? ছেলের বউয়ের কথা শুনে শাশুড়ি কপাল চাপড়ে বলল, সে-কথা আর কী বলি? আমার জন্যই তারা ঘর ছেড়ে চলে গেছে। তাই আজ আমাদের এই দুরবস্থা। কিন্তু মা তুমি কে? পর্দার আড়াল থেকে কথা বলছ কেন?
সঙ্গে সঙ্গে ছয় বউ ঘরে প্রবেশ করল। বউদের দেখে শ্বশুর-শাশুড়ি হতবাক হয়ে গেল। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতে লাগল। ছয় বউ শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে বলল, আপনারা যদি ভুল না করতেন, তবে এতবড় শিক্ষা আমরা কোথা থেকে পেতাম!
শাশুড়ি ছয় বউকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগল। তার পর সেই উত্তরের জঙ্গলে ছয় বউ শ্বশুর-শাশুড়ি এবং স্বামীদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।