আমি মালালা বলছি
উপত্যকা ত্যাগ করা
আমার কাছে সবকিছুর চাইতে কঠিন কাজ ছিল উপত্যকা ছেড়ে চলে যাওয়া। আমার নানির গাওয়া একটা টাপা (প্রচলিত পশতুন ছড়া) আমার মনে পড়ল, ‘কোনো পশতুন নিজ ইচ্ছায় নিজের ভিটা ছাড়ে না। তার কারণ হয় দারিদ্র্য, না হয় প্রেম’। এখন আমরা একটা তৃতীয় কারণের জন্য উপত্যকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছি, সেটা টাপা লেখক কল্পনাও করতে পারেননি, কারণটি হলো তালেবান।
বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় মনে হতে লাগল, আমার হৃৎপিণ্ড উপড়ে নেওয়া হচ্ছে। ছাদে দাঁড়িয়ে আমি পর্বতগুলো দেখলাম, শীর্ষে তুষারাবৃত সেই মাউন্ট ইলাম, যেখানে দাঁড়িয়ে সম্রাট আলেকজান্ডার বৃহস্পতিকে ছুঁয়েছিলেন। সব গাছে পাতা গজাচ্ছিল। আমাদের খুবানিগাছের ফল এ বছর হয়তো অন্য কেউ খেয়ে ফেলবে। সবখানে পিনপতন নিঃস্তব্ধতা। নদী বা বাতাসের শব্দও নেই, এমনকি পাখিরাও গান গাইছিল না।
আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছিল, কারণ বুকের গহিনে আমার মনে হচ্ছিল, এই জন্মভূমিতে আর কখনোই ফিরে আসতে পারব না। প্রামাণ্যচিত্রের নির্মাতারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যদি কোনোদিন এমন হয় যে আমি সোয়াত ছেড়ে গিয়ে আর ফিরতে পারব না। তখন মনে হয়েছিল ওটা বাজে প্রশ্ন, কিন্তু এখন দেখছি, আমার কাছে যা অসম্ভব মনে হয় তার সবই এখন ঘটছে। আমি ভাবতাম স্কুল বন্ধ হবে না, কিন্তু তাই হয়েছে। আমি ভাবতাম আমাদের কখনোই সোয়াত ছেড়ে যেতে হবে না, কিন্তু এখনই আমরা তা করছি। আমি ভাবতাম সোয়াত একদিন তালেবানমুক্ত হবে এবং আমরা আবারও আনন্দিত হব, কিন্তু এখন উপলব্ধি করছি, তা হওয়ার নয়। আমি কাঁদতে শুরু করলাম। ব্যাপারটা এমন ছিল যে একজন অপরজনের শুরু করার অপেক্ষা করছিল। আমার জ্ঞাতি ভাইয়ের স্ত্রী হানি ফোঁপাতে শুরু করল, এরপর আমরা সবাই কাঁদতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার মা খুবই শান্ত ও সাহসী ছিলেন।
আমি আমার সব বই-খাতা স্কুলব্যাগে ঢোকালাম, এরপর আরেক ব্যাগ কাপড়চোপড় গোছালাম। আমি ঠিকমতো চিন্তা করতে পারছিলাম না। আমি একটা সেট থেকে পায়জামা নিয়ে অন্য সেট থেকে জামা নিলাম, ফলে আমার এমন এক ব্যাগ কাপড় হলো যেগুলো একটা অন্যটার সাথে মেলে না। আমি স্কুলের কোনো এ্যাওয়ার্ড বা ছবি বা ব্যক্তিগত অর্জন সাথে নিইনি, কারণ আমরা আরেকজনের গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম এবং সেখানে অল্প জায়গা ছিল। ল্যাপটপ বা অলংকারের মতো দামি কিছু ছিল না আমাদের-টিভি ফ্রিজ এবং ওয়াশিং মেশিনই ছিল আমাদের মূল্যবান জিনিস। আমরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করিনি আমরা পশতুনরা চেয়ারের চেয়ে মেঝেতে বসতেই পছন্দ করি। আমাদের বাড়ির দেয়ালে গর্ত এবং প্রতিটা কাপ প্লেট ফাটা ছিল।
বাবা শেষ মুহূর্ত থেকে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু তখন আমার বাবা-মায়ের কিছু বন্ধু বন্দুকের গুলিতে এক আত্মীয়কে হারিয়েছিলেন এবং সান্ত্বনার জন্য প্রার্থনা করতে তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, যদিও কেউ কোন ঝুঁকি নিয়ে বের হচ্ছিলেন না। তাদের শোক দেখেই আমার মা চলে যেতে মনস্থির করলেন তিনি আমার বাবাকে বললেন, তোমার আসা লাগবে না, কিন্তু আমি বাচ্চাদের নিয়ে শাংলা চলে যাচ্ছি। তিনি জানতেন, বাবা তাঁকে একলা যেতে দেবেন না। মা যথেষ্ট গুলির শব্দ এবং উদ্বেগ সহ্য করেছিলেন এবং তিনি ড. আফজালকে ফোন করে বাবাকে রাজি করাতে অনুরোধ করলেন। তিনি এবং তাঁর পরিবারও যাচ্ছিল, তাই তারা আমাদের লিফট দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমাদের গাড়ি ছিল না তবে আমাদের ভাগ্য ভারো যে আমাদের প্রতিবেশী সাফিনাদের পরিবারও যাচ্ছিল এবং আমাদের কয়েকজনের জায়গা তাদের গাড়িতে হবে। বাকিরা ড. আফজালের সাথে যাবে।
২০০৯ সালের ৫ই মে আমরা আইডিপি হলাম-ইন্টার্নালি ডিসপ্লেসড পার্সনস। অভ্যন্তরেই বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি। শুনে মনে হয় কোনো রোগের নাম।
আমরা অনেকেই ছিলাম - শুধু আমরা পাঁচজন না, আমার নানি, আমার জ্ঞাতি ভাই, তাঁর স্ত্রী হানি এবং তাদের সন্তান। আমরা ভাইরা তাদের পোষা মুরগিগুলো নিতে চাইল- আমারটা মারা গিয়েছিল, কারণ আমি এক শীতের দিনে সেটাকে ঠান্ডা পানিতে গোসল করিয়েছিলাম। বাড়ির জুতার বাক্সে রেখে উষ্ণ করার চেষ্টা করলাম এবং আশপাশের সবাইকে দোয়া করানোর পরও সেটা আর সুস্থ হয়নি। আমার মা মুরগি নিতে রাজি হলেন না। তারা গাড়ি নোংরা করলে? মার প্রশ্ন ছিল এটা। অতল তাদের জন্য ন্যাপি কেনার পরামর্শ দিল। শেষে আমরা তাদের জন্য অনেক পানি আর শস্যদানা রেখে গেলাম। মা আমার স্কুলব্যাগটাও রেখে যেতে বললেন কারণ জায়গা খুবই কম। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। আমি বইগুলোকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা হিসেবে তাদের ওপর কোরআনের আয়াত পড়ে ফুঁ দিলাম।
শেষ পর্যন্ত সবাই তৈরি হলো। আমার মা, বাবা, নানি, জ্ঞাতি ভাইয়ের স্ত্রী, সন্তান এবং আমার ভাইরা ড. আফজালের ভ্যানের পেছনে তাঁর স্ত্রী-সন্তানের সাথে চাপাচাপি করে বসল। বড়দের কোলে ছিল ছোটরা, তাদের কোলে আরো ছোটরা। আমার ভাগ্য কিছুটা ভালো ছিল- সাফিনার গাড়িতে কম লোক ছিল- কিন্তু আমি স্কুলব্যাগের শোকে বিহ্বল ছিলাম। যেহেতু বইগুলো সেখানে আলাদা করে গোছানো হয়েছিল, সবই পেছনে পড়ে রইল।
কোরআনের কিছু সুরা আর একটা বিশেষ দোয়া পড়ে আমরা আমাদের প্রিয় বাসস্থান এবং স্কুল রক্ষা করার চেষ্টা করলাম। এরপর সাফিনার বাবা প্যাডেলে পা রাখলেন এবং আমরা আমাদের রাস্তা, বাড়ি এবং স্কুলের ছোট্ট পৃথিবী ছেড়ে অজানার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমরা জানতাম না আমাদের শহরকে আবারও দেখব কি না। বাজাউরে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এক অভিযানে সেনাবাহিনী কীভাবে সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়েছে সে ছবি আমরা দেখেছিলাম এবং ভাবলাম যে আমাদের চেনা পরিচিত সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে।
রাস্তা ছিল যানজটে বন্দি। আমি এত ব্যস্ত রাস্তা কখনোই দেখিনি। সবখানে গাড়ি, রিকশা, খচ্চরের গাড়ি, মানুষ ও তাদের জিনিসপত্র বোঝাই ট্রাক। পুরো পরিবার বয়ে নিয়ে যাওয়া মোটরবাইকও ছিল। হাজার হাজার মানুষ শুধু পিঠে বেঁধে রাখা কাপড়টুকু নিয়ে ঘর ছাড়ছিল। মনে হচ্ছিল পুরো উপত্যকাটাই চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে পশতুনরা ইসরায়েলের কোনো একটা হারানো উপজাতির উত্তরসূরি, এবং আমার বাবা বললেন, ‘আমরা ইসরাইলিরা যেন মিসর ছাড়ছি, কিন্তু আমাদের পথ দেখানোর জন্য কোনো মুসা নেই।’ খুব কম লোকই জানত তারা কোথায় যাচ্ছে, তারা শুধু জানত তাদেরকে যেতে হবে। পশতুন ইতিহাসে এটাই সর্ববৃহৎ অভিনিষ্ক্রমণ।
মিঙ্গোরা থেকে বেরুনোর অনেক রাস্তা ছিল, কিন্তু তালেবানরা বড় বড় কিছু গাছ কেটে কোনো কোনো পথ বন্ধ করে দিয়েছে, তাই সবাই একই রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। এক মহাসমুদ্র মানুষ ছিল। তালেবানরা বন্দুক নিয়ে রাস্তা টহল দিচ্ছিল এবং বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে আমাদের দেখছিল। তাঁরা বাঁশি নয়, অস্ত্র দিয়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছিল, ‘তালেবানরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে’, নিজেদের উজ্জীবিত রাখতে রসিকতা করলাম আমরা। আমরা নিয়মিত বিরতিতে একেবারে পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং তালেবান চেকপোস্ট অতিক্রম করলাম। আরো একবার মনে হলো, সেনাবাহিনী যেন তালেবানদের উপস্থিতি সম্পর্কে জানেই না।
‘সম্ভবত তাদের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল,’ আমরা হাসলাম, ‘তারা তাদের দেখতে পাচ্ছে না।’
রাস্তাটা যানজটে যেন স্পন্দিত হচ্ছিল। সেটা ছিল খুবই লম্বা এবং ধীরগতির যাত্রা, চাপাচাপি করে বসায় আমরা সবাই খুব ঘর্মাক্ত ছিলাম। আমাদের বাচ্চাদের জন্য গাড়ির যাত্রা সাধারণত রোমাঞ্চকর হয় কারণ আমরা খুব কমই এদিক-সেদিক যাই। কিন্তু এটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সবাই বিষণ্ণ।
ড. আফজালের ভ্যানের ভেতর বাবা মিডিয়ার সাথে কথা বলছিলেন, উপত্যকা পরিত্যাগের ধারাবর্ণনা। তালেবানদের শুনে ফেলার ভয়ে মা তাঁর কণ্ঠ নিচু করতে বলছিলেন। বাবার গলা এতই উঁচু যে মা মজা করে বলেন তাঁর ফোন কল করার প্রয়োজন নেই, কেবল চিৎকার করলেই হবে।
শেষ পর্যন্ত আমরা মালাকান্দের গিরিপথ পেরিয়ে সোয়াতকে পেছনে ফেললাম। উষ্ণ এবং ব্যস্ত শহর মারদানে পৌঁছানোর সময় শেষ বিকেলের কাছাকাছি।
বাবা সবাইকে বলতে থাকলেন, ‘আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসব। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু আমরা জানতাম সেটা সত্যি না।
মারদানে এরই মধ্যে পেশোয়ারের আফগান শরণার্থীদের মতো সাদা ইউএনএইচসিআর তাঁবুর ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। আমরা ক্যাম্পে থাকার মতো বাজে সিদ্ধান্ত নিলাম না। প্রায় ২০ লাখ লোক সোয়াত ছেড়ে এবং এখানে বিশ লাখ লোকের জায়গা হবেই না। তাঁবু থাকলেও সেখানে ভেতরে ভয়ানক গরম ছিল এবং কলেরা ছড়াচ্ছিল বলে শুনেছিলাম। বাবা বললেন, তিনি গুজব শুনেছেন যে তালেবানরা এসব ক্যাম্পের ভেতর লুকিয়ে থেকে নারীদের হয়রানি করছে।
যারা পেরেছিল তারা স্থানীয় লোকজনের বাসা বা বন্ধুবান্ধবের সাথে থাকল। আশ্চর্যজনকভাবে বাস্তুচ্যুত তিন চতুর্থাংশের আশ্রয় দিল মারদান এবং এর নিকটবর্তী শহর সোয়াবির লোকজন। তারা শরণার্থীদের জন্য ঘরবাড়ি, স্কুল, মসজিদের দরজা খুলে দিল। আমাদের সংস্কৃতিতে ধরে নেওয়া হয়, মহিলারা অনাত্মীয় পুরুষের সাথে মিশবে না। মহিলাদের পর্দা রক্ষা করতে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া পরিবারগুলোর পুরুষরা বাড়ির বাইরে ঘুমাতে লাগল। তারা স্বেচ্ছায় বাস্তুচ্যুত হলো। এটা পশতুন আতিথেয়তার এক বিস্ময়কর উদাহরণ। আমরা বলতে থাকলাম যে এই অভিনিষ্ক্রমণ সরকার নিয়ন্ত্রণ করলে আরো অনেক বেশি মানুষ ক্ষুধা আর রোগশোকে ভুগে মারা যেত।
মারদান শহরে আমাদের কোনো আত্মীয় না থাকায় আমরা আমাদের পারিবারিক গ্রাম শাংলায় যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এতক্ষণ আমরা বিপরীত দিকে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সোয়াত থেকে বেরোনোর ওটাই ছিল একমাত্র উপায়।
প্রথম রাতটা আমরা ড. আফজালের বাসায় কাটালাম। বাবা আমাদের রেখে মানুষকে চলমান ঘটনার ব্যাপারে সাবধান করতে পেশোয়ার গেলেন এবং পরে এসে শাংলায় আমাদের সাথে দেখা করবেন বলে কথা দিলেন। মা তাঁকে আমাদের সাথে আনার অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু বাবা নারাজ। তিনি চাইছিলেন পেশোয়ার এবং ইসলামাবাদ বাস্তুচ্যুতদের করুণ অবস্থার ব্যাপারে অবগত হোক এবং সরকার যে কিছুই করছে না এটা জানুক। আমরা তাঁকে বিদায় দিলাম এবং ভয়ংকর আতঙ্কে থাকলাম যে আমরা তাঁকে আর নাও দেখতে পারি।
পরদিন আমরা আমাদের নানির পরিবারের বাসস্থান অ্যাবোটাবাদে গেলাম। সেখানে আমরা আমাদের মতোই উত্তরগামী আমাদের এক জ্ঞাতি ভাই খানজির দেখা পেয়ে গেলাম। সে সোয়াতে একটা ছেলেদের হোস্টেল চালায় এবং কোচে করে সাত-আটজন ছেলেকে কোহিস্তান নিয়ে যাচ্ছিল। সে বেশামে যাচ্ছিল এবং সেখান থেকে শাংলা যেতে আমাদের আরো একটা লিফটের প্রয়োজন হবে।
অনেকগুলো রাস্তা বন্ধ থাকায় বেশাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের রাত হয়ে গেল। আমরা একটা সস্তা নোংরা হোটেলে রাত কাটালাম এবং আমার জ্ঞাতিভাই আমাদের শাংলা পাঠানোর জন্য ভ্যান জোগাড়ের চেষ্টা করছিল। এক লোক আমার মায়ের কাছাকাছি আসতেই তিনি জুতো খুলে লোকটিকে পরপর দুবার আঘাত করলেন এবং সে দৌড়ে পালাল। তিনি লোকটাকে এত জোরে মেরেছিলেন যে জুতোটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ওটা ভেঙে গেছে। আমি সব সময়ই জানতাম আমার মা একজন শক্তিমান মহিলা, কিন্তু এখন আমি তাকে নতুন করে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করলাম।
বেশাম থেকে আমাদের গ্রামে যাওয়া সহজ ছিল না এবং জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের পঁচিশ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছিল। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী আমাদের থামিয়ে বলল যে আর যাওয়া যাবে না এবং ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। ‘আমাদের বাড়ি শাংলায়। কোথায় যাব আমরা?’ আমরা অনুনয় করলাম। নানি কাঁদতে কাঁদতে বললেন যে, তাঁর জীবনে কখনোই এত খারাপ অবস্থায় পড়তে হয়নি। অবশেষে তারা আমাদের যেতে দিল। সেনাবাহিনী এবং তাদের মেশিনগান ছিল সবখানে। কারফিউ এবং চেক পয়েন্টের কারণে রাস্তায় সামরিক বাহিনীর যান ব্যতীত আর কোনো যানবাহন ছিল না। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম সেনাবাহিনী না বুঝে হয় তো আমাদের গুলি করে দিতে পারে।
আমরা পৌঁছানোর পর গ্রামে আমাদের পরিবার আশ্চর্য হয়ে গেল। সবাই বিশ্বাস করত তালেবানরা শাংলায় ফিরে আসবে, তাই তারা বুঝেই উঠতে পারল না কেন আমরা মারদানে থাকিনি।
আমরা আমার মামা ফয়েজ মোহাম্মদ এবং তাঁর পরিবারের সাথে আমার মায়ের গ্রাম কার্শাতে থাকলাম। বেশি জামাকাপড় না আনায় আত্মীয়দের থেকে জামা ধার করতে হয়েছিল। আমি আমার এক বছরের বড় জ্ঞাতিবোন সুম্বুলের সঙ্গ পেয়ে খুবই খুশি হলাম। স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করতেই আমি ওর সাথে স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকলেও সুম্বুলের সাথে পড়ার জন্য সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। এ বয়সের বেশির ভাগ গ্রামের মেয়ে স্কুলে না যাওয়ায় সে বছর ক্লাসে মাত্র তিনটা মেয়ে ছিল, আর মাত্র তিনটা মেয়েকে আলাদাভাবে পড়ানোর মতো যথেষ্ট ঘর বা শিক্ষক না থাকায় আমাদেরকে ছেলেদের সাথেই পড়ানো হতো। আমি সব শিক্ষকের সাথে কথা বলতাম আর প্রশ্ন করতাম এবং চেহারা ঢাকতাম না, তাই অন্য সব মেয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিলাম। কিন্তু আমি বাধ্য এবং ভদ্র থাকার চেষ্টা হিসেবে সব সময় বলতাম, ‘জি, স্যার’।
স্কুলে হেঁটে যেতে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগত, আর আমি সকালে উঠতে অভ্যস্ত না হওয়ায় দ্বিতীয় দিন দেরি হয়ে গেল। শিক্ষক আমাকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমার হাতে লাঠির বাড়ি দিলে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম, কিন্তু এটা বুঝতে পেরে নির্ভার হলাম যে এরা অন্তত আমাকে মেনে নিচ্ছে এবং আলাদা ভাবছে না। মামা আমাকে স্কুলের নাশতা কেনার হাতখরচও দিতেন-তারা মিঙ্গোরার মতো মিষ্টি বা মচমচে খাবার বিক্রি করত না, সেখানে পাওয়া যেত শসা আর তরমুজ।
একদিন স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ও অভিভাবক দিবস ছিল এবং ছেলেদেরকে বক্তৃতা দিতে উৎসাহ দেওয়া হলো। মেয়েরাও অংশ নিল, তবে জনসমক্ষে না। বরং আমরা আমাদের ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে কথা বললাম এবং আমাদের কণ্ঠ মূল হলে শোনানো হলো। কিন্তু আমি জনসমক্ষে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম তাই সব ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটি ‘নাত’ আবৃত্তি করলাম, একটা কবিতা যেখানে নবীজিকে প্রশংসা করা হয়েছে। এরপর শিক্ষকের কাছে আরো কবিতা পড়ার অনুমতি চাইলাম। এরপর আমি মনের বাসনা পূরণে পরিশ্রমের ভূমিকা নিয়ে একটি কবিতা আবৃত্তি করলাম। ‘ছোট্ট একটা রত্ন পাওয়ার জন্য হীরাকে অনেকবার কাটতে হয়,’ আমি বললাম এরপর আমি আমার একনামা মাইওয়ান্দের মালাল কথা বললাম, যার ছিল শত শত হাজার হাজার সাহসী লোকের শক্তি আর ক্ষমতা, যার কয়েক লাইন কাব্য সবকিছু এমনভাবে পাল্টে দিয়েছিল যে ব্রিটিশ পরাজিত হয়েছিল।
দর্শকসারির লোকজনকে দেখে বিস্মিত মনে হচ্ছিল, এবং আমি ভাবতে লাগলাম তারা আমার কাজকর্মকে লোক দেখানো মনে করছে কি না, অথবা নিজেকে জিজ্ঞেস করছে, আমি কেন চেহারা ঢাকিনি।
জ্ঞাতিবোনের সাথ থাকতে ভালোই লাগছিল কিন্তু আমি আমার বইগুলোর জন্য পিছুটান অনুভব করছিলাম। বাড়িতে ফেলে আসা, স্কুলব্যাগ ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘রোমিও এ্যান্ড জুলিয়েট,’ যেগুলো এখনো পড়া হয়নি, শেলফে ‘আগলি বেটি’ ডিভিডি’র কথাই অনবরত ভাবতাম আমি। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই এক নাটকের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমরা খুব সুখী ছিলাম, অনেক খারাপ একটা ব্যাপার আমাদের জীবনে এলো এবং এখন আমরা আনন্দময় সমাপ্তির জন্য অপেক্ষা করছি। আমি আমার বইয়ের ব্যাপারে অভিযোগ তুলতেই ভাইরা তাদের মুরগির জন্য শোক করত।
রেডিওতে শুনলাম সেনাবাহিনী মিঙ্গোরার খণ্ডযুদ্ধ শুরু করেছে। তাদের ছত্রীসেনা ছিল এবং রাস্তায় মল্লযুদ্ধও হয়েছে। তালেবানরা হোটেল এবং সরকারি বিল্ডিংকে বাংকার হিসেবে ব্যবহার করছে। চারদিন পর আর্মি গ্রিন চৌকসহ তিনটা চত্বর দখলে নিল। গ্রিন চৌকে তালেবানরা তাদের শিকারদের মস্তকবিহীন মরদেহ প্রদর্শন করত। এরপর তারা এয়ারপোর্ট আটক করে এক সপ্তাহের মাঝেই শহরে ফিরে গেল।
আমরা বাবাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেই থাকলাম। শাংলায় মোবাইল ফোন সিগন্যাল পাওয়া কঠিন ছিল। মাঠে কোনো বড় প্রস্তরখণ্ডে উঠে দাঁড়িয়েও এক দাগের বেশি নেটওয়ার্ক পাওয়া যেত না, তাই তাঁর সাথে কথা প্রায় হতোই না। কিন্তু শাংলায় প্রায় ছয় সপ্তাহ থাকার পর বাবা আমাদের পেশোয়ারে যেতে বললেন, যেখানে তিনি তিন বন্ধুর সাথে একঘরে থাকতেন।
তাঁর সাথে আবার দেখা হওয়াটা খুব আবেগময় ব্যাপার ছিল। এরপর, আবারও পূর্ণাঙ্গ পরিবারে রূপান্তরিত হয়ে আমরা ইসলামাবাদে গিয়ে স্ট্যানফোর্ড থেকে আমাদের ফোন করা শিজার পরিবারের সাথে থাকলাম। সেখানে থাকাকালে শুনলাম যে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মার্কিন বিশেষ বার্তাবহ রিচার্ড হলব্রুক এই সমস্যার ব্যাপারে সেরেনা হোটেলে সভা করেছেন, এবং আমি আর বাবা কোনোভাবে ভেতরে গেলাম।
ভালো মতো অ্যালার্ম না দেওয়ায় বাবা আমার সাথে প্রায় কথাই বলতে পারেননি এবং আমরা প্রায় সভায় না যাওয়ারই অবস্থা হয়েছিল। হলব্রুক ছিল লাল মুখওয়ালা বড়সড় এক বদমেজাজি লোক, কিন্তু মানুষজন বলছিল সে বসনিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল। আমি তাঁর পাশে বসলাম এবং তিনি আমার বয়স জিজ্ঞেস করলেন। যথাসম্ভব লম্বা দেখানোর চেষ্টা করে আমি উত্তর দিলাম, ‘সম্মানিত রাষ্ট্রদূত, আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি আমাদের মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ করতে সাহায্য করুন আমি বললাম।
তিনি হাসলেন, ‘তোমাদের অনেক সমস্যা আছে এবং আমরা তোমাদের জন্য অনেক কিছুই করছি, তিনি উত্তর দিলেন। ‘আমরা তোমাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা জামানত দিয়েছি; বিদ্যুৎ, গ্যাসের সরবরাহের ব্যাপারে তোমাদের সরকারের সাথে আমরা কাজ করছি....তবু তোমাদের দেশে অনেক সমস্যা।’
পাওয়ার ৯৯ নামের একটি রেডিও স্টেশন আমার সাক্ষাৎকার নিল। তারা সেটা খুব পছন্দ করল এবং অ্যাবোটাবাদে তাদের গেস্টহাউসে আমাদের সবাইকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। আমরা সেখানে সপ্তাহখানেক থাকলাম এবং খুবই আনন্দিত হয়ে জানতে পারলাম যে মনিবা, আমার এক শিক্ষক এবং আরেক বন্ধুও অ্যাবোটাবাদে আছে। আইডিপি হওয়ার আগে শেষ দিনের ঝগড়াটার পরে আমি আর মনিবা কথাই বলিনি। আমরা পার্কে দেখা করার ব্যবস্থা করলাম এবং আমি ওকে বিস্কুট ও পেপসি কিনে দিলাম। ‘সব তোমার দোষ ছিল,’ মনিবা বলল। আমি মেনে নিলাম। কিছু মনে করলাম না; আমি কেবল বন্ধু হতে চেয়েছিলাম।
গেস্টহাউসের এক সপ্তাহ দ্রুতই ফুরিয়ে গেল এবং আমরা আমার এক আন্টির কাছে হরিপুরে গেলাম। দুই মাসের মধ্যে ওটা আমাদের চতুর্থ শহর। আমি যানতাম ক্যাম্পে যারা থাকছে তাদের চাইতে আমি ভালো আছি, সেখানে রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাবার আর পানির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু আমার উপত্যকার জন্য আমার খারাপ লাগতে থাকল। ওখানে আমি আমার দ্বাদশ জন্মদিন উদযাপন করেছিলাম। কারোই মনে ছিল না। এমনকি বাবাও ভুলে গেলেন, ছোটাছুটিতে তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন। আমি মন খারাপ করে ভাবতে থাকলাম একাদশতম জন্মদিনটা কত আলাদা ছিল। আমি আমার বন্ধুদের সাথে কেক ভাগাভাগি করেছিলাম। বেলুন ছিল এবং এই জন্মদিনের মতো সেই জন্মদিনেও আমি একই ইচ্ছা করেছিলাম, কিন্তু এবার কোনো কেক বা ফুঁ দেওয়ার জন্য কোনো মোমবাতিও নেই। আরো একবার আমি আমাদের উপত্যকার শান্তি কামনা করলাম।
(চলবে)