আমি মালালা বলছি
দুঃখের উপত্যকা
হে পথিক। পাথুরে খোয়ার মাথা রাখো
এটা পরদেশ—তোমার রাজার রাজ্য নয়।
পুরোটা যেন এক দুঃস্বপ্ন। বিশাল বৌদ্ধ স্তূপা, টিলার ওপর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, চার্চিলের পিকেট পেরিয়ে যেতে ভাবলাম, প্রায় তিন মাস আমরা আমাদের উপত্যকা ছেড়ে আছি। প্রশান্ত সোয়াত নদী দেখে বাঁশি ফোঁফাতে শুরু করলেন। সোয়াত মনে হলো সম্পূর্ণ সামরিক শাসনের অধীনে। মালাকান্দ গিরিপথ পেরোনোর আগে আমাদের যানটাকেও বিস্ফোরক চেকের নিচ দিয়ে যেতে হলো। ওই পাশে গিয়ে উপত্যকায় নামতেই মনে হলো, সবখানে সামরিক চেকপয়েন্ট আছে এবং অনেক বাড়ির ছাদে সৈন্যরা মেশিনগানের আস্তানা গেড়ে রেখেছে।
গ্রামের ভেতরের দিকে যেতেই ধ্বংসপ্রাপ্ত দালান আর পুড়ে যাওয়া যানবাহন চোখে পড়ল। এসব দেখে আমার পুরোনো যুদ্ধের চলচ্চিত্র অথবা খুশালের পছন্দের ভিডিও গেমের কথা মনে হলো। মিঙ্গোরায় পৌঁছে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। প্রতিটা রাস্তায় সেনাবাহিনী-তালেবান লড়াই হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটা দেয়ালেই গুলির গর্ত।
তালেবানের পালানোর স্থান হিসেবে ব্যবহৃত বিল্ডিংগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং সে জায়গায় কেবল ধুলো, আর ছিল ধ্বংসাবশেষের স্তূপ, মোচড়ানো ধাতু আর মিশে যাওয়া চিহ্ন। বেশিরভাগ দোকানেই ভারি ধাতুর শাটার ছিল; যাদের ছিল না তাদের দোকান লুট হয়েছে। পুরো শহর নিস্তব্ধ, মানুষ এবং যানবাহন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেন প্লেগ নেমে এসেছে। সবচেয়ে আজব দৃশ্য ছিল বাসস্ট্যান্ডে। সাধারণত ওই জায়গায় ফ্লাইং কোচ এবং রিকশার যন্ত্রণায় হাঁটাই দায়, কিন্তু এখন সেটা একেবারেই বিরান। রাস্তার ইটের আস্তরের ভেতর দিয়ে গাছ গজাচ্ছে। আমাদের শহরের এমন রূপ আমরা আগে কখনই দেখিনি। অন্তত তালেবানের কোনো চিহ্ন নেই।
দিনটি ছিল ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই, তালেবানের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে। তিনি কথা দিয়েছিলেন যে গ্যাস সরবরাহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাংক খুলেছে, এবং সোয়াতে লোকজনকে ফিরে যেতে বললেন। শেষে ১৮ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেই উপত্যকা ছেড়ে চলে গেল। যা দেখলাম তা থেকে মনে হলো, বেশিরভাগ লোকই নিশ্চিত যে শহরটা নিরাপদ।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছাতেই সবাই চুপ হয়ে গেলাম, এমনকি আমার বাচাল ছোট ভাই অতলও। আমাদের বাড়ি ছিল সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয় সার্কিট হাউসের কাছেই, তাই ভয় পাচ্ছিলাম যে তা শেলের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অনেক বাড়িতে লুট হয়েছে বলেও শুনেছিলাম। বাবা দরজার তালা খুলছিলেন সময়ে আমাদের কারোরই নিশ্বাস পড়ছিল না। প্রথম যে জিনিসটা দেখলাম তা হলো আমাদের অনুপস্থিতির তিন মাসে বাগানটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
ভাইরা তাদের মুরগির খোঁজ নিতে দৌড় দিল এবং কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলো। পালক আর হাড়ের স্তূপ ছাড়া কিছুই বাকি নেই, এমনভাবে জড়িয়ে আছে যেন একে অপরকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মারা গেছে। অনাহারে মারা গেছে তারা।
ভাইদের জন্য খুব খারাপ লাগলেও আমার নিজেরও কিছু দেখার ছিল। খুবই আনন্দের সঙ্গে আবিষ্কার করলাম যে স্কুলব্যাগে গোছানো বইগুলো ঠিকই আছে, অর্থাৎ আমার প্রার্থনা কাজে লেগেছে এবং বইগুলো নিরাপদেই আছে। একটা একটা করে বইগুলো বের করে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, উর্দু, ইংরেজি, পশতু, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইসলামিয়াত এবং পাকিস্তান পরিচিতি। অবশেষে আমি নির্ভয়ে স্কুলে যেতে পারব।
এরপর আমি গিয়ে বিছানার ওপর বসলাম। আমি অভিভূত।
আমরা ভাগ্যবান, আমাদের বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়নি। আমাদের গলির চার-পাঁচটা বাড়িতে লুট করা হয়েছে এবং স্বর্ণালংকার চুরি হয়েছে। পাশের বাসার সাফিনার মা নিরাপত্তার কারণে তার স্বর্ণ ব্যাংকের ভল্টে রেখেছিলেন, সেটাও হাপিশ।
বাবা স্কুলের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। আমিও তাঁর সঙ্গে গেলাম। আমরা দেখলাম যে বালিকা বিদ্যালয়ের বিপরীত পাশের দালানটা মিসাইল দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু স্কুলটা অক্ষত। কোন কারণে বাবার চাবিগুলো কাজ করছিল না, তাই একটা ছেলে দেয়াল টপকে গিয়ে ভেতর থেকে খুলে দিল। সবচেয়ে খারাপটা দেখার আশঙ্কা বুকে নিয়েই ভেতরে গেলাম।
আঙিনায় পা দিয়েই বাবা বললেন; এখানে কেউ এসেছিল। সারা মেঝেতে সিগারেটের টুকরা এবং খাবারের খালি বাক্স পড়ে ছিল। চেয়ার উল্টানো, পুরো জায়গাটা এলোমেলো। বাবা খুশাল স্কুলের সাইনবোর্ড খুলে উঠানে রেখে গিয়েছিলেন। সেটা দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দেওয়া ছিল, এবং সেটা সরাতেই আমি চিৎকার করে উঠলাম। নিচে ছিল পচন ধরা ছাগলের মাথা। কারো রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট বলে মনে হচ্ছিল।
এরপর আমরা ক্লাসরুম দেখতে গেলাম। দেয়ালে সব তালেবানবিরোধী স্লোগান লেখা। কেউ একজন পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে হোয়াইটবোর্ডে ‘আর্মি জিন্দাবাদ’ লিখে রেখেছিল। এবার আমরা বুঝতে পারলাম এখানে কারা ছিল। এক সৈনিক আমার এক সহপাঠীর ডায়েরিতে মামুলি প্রেমের কবিতাও লিখে রেখেছে, সারা মেঝেয় গুলির খোসা ছিটানো। সৈন্যরা দেয়ালে একটা গর্ত করে রেখেছে, যেটা দিয়ে নিচে শহরটা দেখা যায়। হয়তো সে গর্ত দিয়ে মানুষকে গুলি করেছে। আমাদের মূল্যবান স্কুলটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল ভেবে আমার খুব খারাপ লাগল।
আশপাশে তাকানোর সময় হঠাৎ নিচতলার দরজায় বাড়ি দেওয়ার শব্দ শুনলাম। ‘ওটা খুলো না মালালা।’ আমার বাবা নির্দেশ দিলেন।
অফিসে বাবা সেনাবাহিনীর রেখে যাওয়া একটা চিঠি পেলেন। সেটাতে তালেবানকে সোয়াত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য আমাদের মত নাগরিকদের দোষারোপ করা হয়েছে। ‘আমাদের অনেক সৈনিকের মূল্যবান জীবন আমরা হারিয়েছি তোমাদের অবহেলার কারণে। পাক আর্মি জিন্দাবাদ,’ বাবা পড়লেন।
‘অদ্ভুতই বটে,’ তিনি বললেন। ‘প্রথমে আমরা সোয়াতের লোকজন তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, এরপর তাদের হাতে খুন হয়েছি আর এখন তাদের জন্যই অভিযুক্ত হচ্ছি। প্রতারিত, খুন হওয়া আর অভিযুক্ত।’
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সঙ্গে জঙ্গিদের খুব সামান্যই পার্থক্য ছিল। এক প্রতিবেশী আমাদের বললেন যে তিনি সেনাবাহিনীকে সর্বসাধারণের দেখার জন্য তালেবানদের মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে রাখতে দেখেছেন। বড় কালো গুঞ্জনরত পোকার মত তাদের হেলিকপ্টারগুলো এখন জোড়ায় জোড়ায় মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়, এবং বাড়ি ফেরার সময় আমরা দেয়ালের কাছাকাছি থাকতাম, যাতে তারা আমাদের দেখতে না পায়।
আমরা শুনলাম যে আট বছর বয়সী বালকসহ হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়েছে, যাদের আত্মঘাতী হামলার প্রশিক্ষণের জন্য ব্রেনওয়াশ করা হয়েছে। আর্মি তাদের সংস্কারকামী মতবাদ থেকে সরিয়ে আনার জন্য জিহাদিদের বিশেষ ক্যাম্পে পাঠিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত লোকজনের মাঝে একজন আমাদের পুরোনো উর্দু শিক্ষক যিনি মেয়েদের পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ফজলুল্লাহর লোকজনকে সিডি-ডিভিডি সংগ্রহ করতে এবং ধ্বংস করতে সাহায্য করেছিলেন।
ফজলুল্লাহ নিজেও পালিয়ে ছিলেন। আর্মি ইমাম দেরিতে তার প্রধান কার্যালয় ধ্বংস করে ফেলেছিল এবং পেওচারের পর্বতে তাকে ঘিরে ফেলেছে বলে দাবি করেছিল। এরপর তারা বলল যে সে মারাত্মকভাবে আহত এবং তার মুখপাত্র মুসলিম খানকে হেফাজতে নিল। পরে কাহিনী পাল্টে গেল, তারা জানাল যে ফজলুল্লাহ আফগানিস্তানে পালিয়ে গেছে এবং কুনার প্রদেশে আছে। কেউ কেউ বলেছিল যে ফজলুল্লাহকে আটক করা হয়েছিল কিন্তু সেনাবাহিনী এবং আইএসআই তাকে নিয়ে কী করবে সে ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। সেনাবাহিনী তাকে কারাগারে রাখতে চাইলে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস অবতীর্ণ হয়ে তাকে বাজাউর নিয়ে যায়, যাতে সে সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যেতে পারে।
মনে হতে লাগল যে মুসলিম খান ও মেহমুদ নামের আরেক কমান্ডার—এ দুজনই তালেবান নেতাদের মধ্যে হেফাজতে আছে, অন্য সবাই-ই মুক্ত। যত দিন ফজলুল্লাহ আশপাশে আছে, আমি ভয় পাচ্ছিলাম তালেবান আবার একত্র হয়ে ক্ষমতা হাতে তুলে নেবে। মাঝেমধ্যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখতাম, কিন্তু তার রেডিও সম্প্রচারটা তো বন্ধ হয়েছে।
আমার বাবার বন্ধু আহমাদ শাহ একে বলল ‘স্থায়ী নয় নিয়ন্ত্রিত শান্তি’। কিন্তু ক্রমেই মানুষ উপত্যকায় ফিরে এল কারণ সোয়াত খুব সুন্দর স্থান এবং একে ছেড়ে আমরা বেশিদিন থাকতে পারি না।
আবারো আগস্টের ১ তারিখে প্রথমবারের মত আমাদের স্কুলের ঘন্টা বাজল। শব্দটা শোনা এবং আগের মত দরজা দিয়ে দৌড়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওঠাটা কতই আনন্দের ছিল। পুরোনো বন্ধুদের দেখে আমি আনন্দে উদ্বেলিত হলাম। উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে আমাদের অনেক কথা বলার ছিল। বেশিরভাগই পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে থেকেছি কিন্তু কেউ কেউ ক্যাম্পে ছিল। আমরা জানতাম আমরা ভাগ্যবান। অনেক শিশুকে তাঁবুতে ক্লাস করতে হয়েছিল। আমার এক বান্ধবী সুন্দুসের বাবা এক বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন।
মনে হলো যে সবাই জানে আমিই বিবিসি ডায়েরিটা লিখেছি। কেউ কেউ ভাবল, আমার বাবাই আমার হয়ে লিখে দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের অধ্যক্ষ ম্যাডাম মারিয়াম ওদের বললেন, ‘না, মালালা শুধু ভালো বক্তাই না, সে একজন ভালো লেখকও বটে।’
ওই গ্রীষ্মে আমাদের ক্লাসে কথা বলার একটাই বিষয় ছিল। আমাদের ইসলামাবাদের বন্ধু শিজা শাহিদ স্ট্যানফোর্ডে পড়াশোনা শেষ করেছেন এবং খুশাল স্কুলের ২৭ জন ছাত্রীকে ঘুরে বেড়াতে এবং কর্মশালায় অংশ নিয়ে তালেবানের অধীনে থাকার বিভীষিকাটা ভুলে যেতে রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানালেন। আমার ক্লাসের মেয়েদের মধ্যে ছিলাম আমি, মনিবা, মালকা-ই-নূর, রিদা, কারিশমা এবং সুন্দুস, এবং আমাদের অভিভাবক হিসেবে ছিলেন মা এবং ম্যাডাম মারিয়াম।
সবাই খুব উত্তেজনায় উৎফুল্ল, আগস্ট মাসের ১৪ তারিখ স্বাধীনতা দিবসে রাজধানীর উদ্দেশে আমরা বাসযাত্রা শুরু করলাম। বেশিরভাগ মেয়েই কেবল আইডিপি হওয়ার পর প্রথমবারের মতো উপত্যকা ছেড়েছিল। এটা ছিল আলাদা এবং অনেকটা উপন্যাসে পড়া অবকাশের মতো। আমরা একটা গেস্টহাউসে থাকলাম এবং আমাদের কাহিনী কীভাবে বাইরে বলব, যাতে মানুষ জানতে পারে আমাদের উপত্যকায় কী ঘটছে এবং আমাদের সাহায্য কার, তার ওপর প্রচুর কর্মশালায় অংশ নিলাম। আমার মনে হলো, আমাদের দৃঢ় মনোবল এবং বাচনিকতা দেখে শিজা প্রথম পর্ব থেকেই বিস্মিত ছিল। ‘এ তো এর ঘরভর্তি মালালা !’ সে আমার বাবাকে বলল।
আমরা পার্কে যাওয়া এবং গান শোনার মতো মজার কাজও করলাম, এটা অধিকাংশ মানুষের কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে; কিন্তু সোয়াতে এটা ছিল রাজনৈতিক প্রতিবাদের ব্যাপার এবং আমরা শহর ঘুরে দেখলাম। মিলিয়ন মিলিয়ন রুপি দিয়ে সৌদিদের নির্মিত ফয়সাল মসজিদ, মাগালা পাহাড়ের পাদদেশের এই মসজিদ দেখলাম। এটা বিশাল এবং সাদা এবং দেখতে মনে হয় মিনারের মাঝে ঝোলানো উজ্জ্বল একটা তাবু। ‘টিম, ডিক অ্যান্ড হ্যারি’ নামের একটা ইংরেজি মঞ্চনাটক দেখতে প্রথমবারের মতো আমরা থিয়েটারে গেলাম, আর্ট ক্লাস করলাম। রেস্তোরাঁয় খেলাম এবং প্রথমবারের মতো ম্যাকডোনাল্ডসে খেলাম। সেখানে অনেক কিছুই প্রথমবারের মতো করেছিলাম, যদিও ‘ক্যাপিটাল টক’ নামের একটি টিভি অনুষ্ঠানে থাকার কারণে একটি চাইজিন রেস্টুরেন্টের খাওয়ার সুযোগ হারালাম। আজ পর্যন্ত আমি ‘ডাক প্যানকেক’ খেতে পারিনি।
ইসলামাবাদ এবং সোয়াত সম্পূর্ণ আলাদা। নিউইয়র্কের সঙ্গে ইসলামাবাদের যে পার্থক্য, আমাদের কাছে সোয়াতের সঙ্গে ইসলামাবাদেরও সে একই পার্থক্য। শিজা আমাদের সঙ্গে আইনজীবী, ডাক্তার এবং আন্দোলনকর্মী নারীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে নারীরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বজায় রেখেও গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতে পারেন। আমরা পর্দাবিহীন নারীও রাস্তায় দেখলাম, মাথা সম্পূর্ণ অনাবৃত। কোনো কোনো সভায় আমি মাথায় চাদর পরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে ভাবলাম, আমি খুব আধুনিক হয়ে গেছি। পরে আমার বোধোদয় হয়, কেবল মাথা অনাবৃত করলেই আধুনিক হওয়া যায় না।
আমরা সেখানে এক সপ্তাহ ছিলাম এবং যথারীতি আমি আর মনিবা ঝগড়া করলাম। সে আমাকে এক বছরের বড় একটা মেয়ের সঙ্গে গল্প করতে দেখে বলল, ‘তুমি থাকো তোমার রেশামকে নিয়ে, আমি রিদার সঙ্গে গেলাম।’
শিজা আমাদের প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে পরিচয় করাতে চাইলেন। আমাদের দেশে এই কথাটার অর্থ অবশ্যই সামরিক বাহিনীর সদস্য। একটা সভা আমরা করেছিলাম মেজর জেনারেল আতহার আব্বাসের সঙ্গে, যিনি সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র এবং এর জনসংযোগ বিভাগের প্রধান। তাঁর অফিসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আমরা ইসলামাবাদের যমজশহর রাওয়ালপিন্ডিতে গেলাম। চমৎকার সবুজ উঠান, ফুটে থাকা সম্বলিত আর্মি হেডকোয়ার্টার্স ছিল শহরের অন্য অংশের চেয়ে অনেক পরিচ্ছন্ন, যা দেখে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এমনকি প্রতিটা গাছই সমান উচ্চতার এবং সবকটিই কাণ্ডের মধ্যভাগ পর্যন্ত সাদা রং করা, কেন জানি না। কার্যালয়ের ভেতর আমরা টেলিভিশনের ব্যাংকওয়ালা অফিস দেখলাম, লোকজন প্রতিটা চ্যানেল পর্যবেক্ষণ করছে, এবং এক অফিসার বাবাকে কাটিংভর্তি একটা পুরু ফাইল দেখালেন, যাতে সেদিনের পত্রিকায় আর্মি সম্পর্কে ছাপানো সব লেখা আছে। তিনি অবাক হয়ে গেলেন। আমাদের রাজনীতিবিদদের চেয়ে সেনাবাহিনীকেই জনসংযোগে বেশি কার্যকর বলে মনে হলো।
জেনারেলের জন্য অপেক্ষা করতে আমাদের একটি হলে নিয়ে যাওয়া হলো। দেয়ালে ছিল আমাদের সব সেনাপ্রধানের ছবি, মোশাররফের মতো স্বৈরাচারী থেকে শুরু করে জিয়ার মতো ভয়ানক লোক, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী লোকজন। সাদা দস্তানা পরা এক পরিচারক আমাদের জন্য চা-বিস্কুট এবং মুখের ভেতর গলে যাওয়া ছোট ছোট মাংসের সমুচা নিয়ে এলো। জেনারেল আব্বাস ভেতরে এলেই আমরা সবাই দাঁড়ালাম।
সোয়াতের সামরিক অভিযানকে বিজয় বলে অভিহিত করেই আমাদের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। তাঁর ভাষ্যমতে, অভিযানে ১২৮ জন সৈনিক এবং ১৬০০ জঙ্গি মারা গিয়েছিল।
তাঁর কথা শেষ হলে আমরা প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম। আমাদেরকে আগে থেকে প্রশ্ন তৈরি রাখতে বলা হয়েছিল তাই আমি সাত-আটটা প্রশ্নের একটা তালিকা করে রেখেছিলাম। শিজা হেসে দিলেন, বলেছিলেন যে তিনি এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। আমি সামনের সারিতে থাকায় আমাকেই প্রথম ডাকা হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘দু-তিন মাস আগে আপনারা বলেছিলেন যে, ফজলুল্লাহ এবং তার সহকারী গুলিবিদ্ধ ও আহত, এরপর বললেন তারা সোয়াতে আছে আবার আপনাদের কেউ কেউ বলে তারা আফগানিস্তানে আছে। তারা কীভাবে সেখানে গেল। আপনাদের কাছে এত তথ্য থাকলে তাদের আপনারা ধরলেন না কেন?’
তাঁর জবাবটা চলল ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে এবং আসলে তিনি কী বলতে চেয়েছেন, তা আমি বুঝেই উঠতে পারলাম না। এরপর আমি পুনর্গঠনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। ‘উপত্যকার ভবিষ্যতের জন্যও সেনাবাহিনীর কিছু করতে হবে, শুধু সামরিক অভিযানের ওপর জোর দিলেই হবে না,’ আমি বলেছিলাম।
মনিবা এর কাছাকাছিই একটা প্রশ্ন করল। ‘কে এই দালান আর স্কুল পুনর্নির্মাণ করবে?’ সে জানতে চাইল।
জেনারেল খুবই সামরিক কায়দায় জবাব দিল ‘অভিযানের পর প্রথমে আমরা পুনরুদ্ধার কাজ চালাব এরপর সংস্কার করব, এবং এর পর সবকিছু সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে স্থানান্তর করব।’
আমরা সব মেয়ে মিলে স্পষ্ট করে তুললাম যে আমরা তালেবানকে বিচারাধীন দেখতে চাই, কিন্তু এটা বাস্তবে ঘটার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না।
শেষে জেনারেল আব্বাস তাঁর ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, কখনো কিছু প্রয়োজন হলে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি।
শেষ দিনে, আমাদের সবাইকে তালেবানের শাসনাধীন থাকার অভিজ্ঞতার ব্যাপারে ইসলামাবাদ ক্লাবে বক্তৃতা দিতে বলা হলো। মনিবা কথা বলার সময় চোখের পানি আটকাতে পারল না এবং দ্রুতই সবাই ফোঁপাতে লাগল। ইসলামাবাদে আমরা ভিন্ন জীবনের একঝলক উপভোগ করলাম। আমার বক্তব্যে আমি শ্রোতাদের বললাম যে ইংরেজি নাটকটা না দেখা পর্যন্ত আমার ধারণাই ছিল না যে পাকিস্তানে এত মেধাবী মানুষ আছে। ‘এখন আমরা বুঝতে পারছি আমাদের ভারতীয় ছবি দেখার প্রয়োজন নেই,’ আমি মশকরা করলাম। চমৎকার সময় কাটিয়েছিলাম, এবং সোয়াতে ফিরে ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমি এতই আশাবাধী হলাম যে বাগানে একটা আমের আঁটি পুঁতে দিলাম, কারণ রমজান মাসে ইফতারিতে আম খেতে বেশ ভালো লাগে।
কিন্তু বাবার একটা বড় সমস্যা ছিল। আমরা যত দিন উদ্বাস্তু ছিলাম, তত দিন স্কুল বন্ধ ছিল এবং তিনি কোনো বেতন সংগ্রহ করেননি, কিন্তু শিক্ষকরা তখনো বেতন পাবার আশা করছিলেন। সব মিলিয়ে তা প্রায় ১০ লাখ রুপি হবে। সব প্রাইভেট স্কুলেরই একই দশা। আমাদের স্কুল এক মাসের বেতন দিল কিন্তু বেশির ভাগ স্কুলই বেকায়দায় পড়ল কারণ বেতন দেওয়ার সামর্থ্য তাদের ছিল না। খুশাল স্কুলের শিক্ষকরা কিছু একটা দাবি করলেন। তাঁদের নিজেদেরও ব্যয় ছিল, এবং তাঁদের মধ্যে একজন, মিস হেরা, বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন এবং অনুষ্ঠানের খরচের জন্য বেতনের ওপর নির্ভর করছিলেন।
বাবা বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন। তখন আমাদের জেনারেল আব্বাসের ভিজিটিং কার্ডের কথা মনে পড়ল। তালেবানের বিদায় করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সামরিক অভিযানের ফলেই তো আমাদের উপত্যকা ছাড়তে হয়েছে এবং এ অবস্থায় পড়তে হয়েছে। তাই আমি এবং ম্যাডাম মারিয়াম অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জেনারেল আব্বাসের কাছে একটা ই-মেইল পাঠালাম। তিনি খুব দয়ালু ছিলেন এবং ১১ লাখ রুপি পাঠিয়ে দিলেন, বাবা সবাইকে তিন মাসের বেতন দিতে পারলেন। শিক্ষকরা খুব খুশি হলেন। বেশিরভাগ শিক্ষকই কখনো এত টাকা একসঙ্গে পাননি। মিস হেরা চোখে পানি নিয়ে বাবাকে ফোন করলেন, বিয়েটা পরিকল্পনামাফিক আগানোয় বাবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ।
তার মানে এই নয় আমরা আর্মিকে সহজে ছেড়ে দিলাম। তালেবান নেতাদের গ্রেপ্তারে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতায় আমরা অখুশি ছিলাম এবং আমি আর বাবা সাক্ষাৎকার দেওয়া চালিয়ে গেলাম। বাবার বন্ধু এবং সোয়াত কৃত্তমি জিরগার সদস্য জাহির খান প্রায়ই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তিনি সমগ্র সোয়াত হোটেল সংসদের প্রেসিডেন্টও ছিলেন, তাই তিনি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন যাতে পর্যটক ফিরে আসে। আমার বাবার মতই তিনি স্পষ্টভাষী ছিলেন এবং হুমকিও পেয়েছিলেন। ২০০৯ সালের নভেম্বরের এক রাতে তিনি খুব অল্পের জন্য বেঁচে যান। জাহিদ খান সার্কিট হাউসে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক সভা শেষে গভীর রাতে বাড়ি ফেরার পথে তাঁকে অ্যামবুশ করা হয়। সৌভাগ্যবশত তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য একই এলাকায় থাকতেন, এবং তাঁরাও পাল্টা গুলি ছুড়ে আক্রমণকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করেন।
এরপর ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখ স্থানীয় এএনপি রাজনীতিবিদ এবং খাইবার পখতুনখোয়া অ্যাসেম্বলির সদস্য ড. শমশের আলী খানের ওপর আত্মঘাতী হামলা হয়। ফজলুল্লাহর প্রাক্তন হেডকোয়ার্টার্স ইমাম দেরি থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরে নিজের হুজরায় তিনি বন্ধু এবং নির্বাচক মন্ডলীর সদস্যদেরকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন, তখনই বিস্ফোরণটা ঘটে। ড. শমশের ছিলেন তালেবানের এক স্পষ্টভাষী সমালোচক। তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং আরো নয়জন আহত হয়। মানুষ বলেছিল, হামলাকারীর বয়স আঠারো বছরের মতো। পুলিশ তার পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশ খুঁজে পায়।
এর দুই সপ্তাহ পরে আমাদের স্কুলকে সোয়াত জেলা শিশু সমিতিতে অংশগ্রহণ করতে বলা হলো, সেটা দাতব্য ইউনিসেফ এবং খপাল কোর (আমার বাড়ি) ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অনাথ শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সমগ্র সোয়াত থেকে সদস্য হিসেবে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে নির্বাচন করা হয়। আমাদের স্কুল থেকে ১১ জন মেয়ে গেলেও বেশিরভাগই ছেলে ছিল। প্রথম সভাটা হলো অনেক রাজনীতিবিদ এবং আন্দোলনকর্মীর সঙ্গে একটা হলঘরে আমরা স্পিকারের জন্য নির্বাচনের আয়োজন করলাম এবং আমি বিজয়ী হলাম। মঞ্চে উঠে দাঁড়ানো এবং সবার মুখে ‘জনাব স্পিকার’ শুনতে খুবই অদ্ভুত লাগছিল, কিন্তু আমরা সবাই মুখ খুলতে পারায় ভালোও লাগছিল। সমিতিতে এক বছরের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আমরা প্রায় প্রতি মাসেই বসতাম। শিশুশ্রম বন্ধ করা, প্রতিবন্ধী এবং পথশিশুদের স্কুলে পাঠানো এবং তালেবানের উড়িয়ে দেওয়া স্কুল পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে আমরা নয়টি প্রস্তাব পাশ করালাম। প্রস্তাব পাস হওয়ার পরপরই তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হত এবং বেশ কিছু দাবি বাস্তবায়িতও হয়েছিল।
আমি, আয়েশা এবং মনিবা ‘ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার অ্যান্ড পিস রিপোর্টিং’ নামে এক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান থেকে সাংবাদিকতা শিখতে লাগলাম, সেই প্রতিষ্ঠান ‘ওপেন মাইন্ডস পাকিস্তান’ নামের একটি প্রকল্প পরিচালনা করে। একটি ঘটনা রিপোর্ট করতে শেখাটা বেশ মজাই। আমেরিকা ম্যাগাজিনের সাংবাদিকের জীবন নিয়ে তৈরি ‘আগামী বেটি’ ডিভিডি দেখে এবং আমার নিজের কথা কীভাবে সব বদলে দিতে পারে-তা দেখে আমি সাংবাদিকতায় আগ্রহী হয়ে উঠলাম। এটা কিছুটা আলাদা ছিল- আমরা আমাদের নিজেদের ব্যাপার নিয়ে লিখতাম, জামাকাপড় বা চুলের সজ্জার চেয়ে বরং চরমপন্থা এবং তালেবানের নিয়ে লেখাই যুক্তিযুক্ত ছিল।
খুব দ্রুতই পরীক্ষা চলে এলো। খুব স্বল্প ব্যবধানে হলেও মালকা-ই-নূরকে হারিয়ে আমিই প্রথম স্থান অধিকার করলাম। আমাদের প্রধান শিক্ষিকা তাকে স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ ছাত্রী হওয়ার জন্য বেশ অনুরোধ করলেনও সে জানাল, পড়ালেখা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে এমন কিছু সে করতে রাজি নয়। ‘তোমার মালালাকে আরো বেশি অনুসরণ করা উচিত এবং অন্যান্য কাজ করা উচিত,’ ম্যাডাম মারিয়াম বললেন। ‘এটা তোমার পড়ালেখার মতই গুরুত্বপূর্ণ। কাজই সবকিছু নয়।’ কিন্তু আমি ওকে দোষারোপ করতে পারি না। সে আসলেই তার বাবা-মাকে খুশি করতে চাইত, বিশেষত মাকে।
সোয়াত আগের মতো ছিল না, হয়তো কোনোদিনই হবে না; কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিল। এমনকি বানর বাজারের কোনো কোনো নৃত্যশিল্পীও ফিরে এসেছিল, যদিও তারা সরাসরি উপস্থাপন করার চেয়ে ডিভিডি বানিয়ে বিক্রি করত। আমরা নাচ-গান দিয়ে শান্তিপূর্ণ উৎসব পালন করতাম, যেটা তালেবানের অধীনে ভাবাই যেত না। বাবা মারঘাজারে একটা অনুষ্ঠান করে ধন্যবাদ হিসেবে নিম্নাঞ্চলের জেলায় যাঁরা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছিল, তাঁদের নিমন্ত্রণ করেন। সারা রাত গান চলেছিল।
আমার জন্মদিনের আশপাশের সময়গুলোর কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে, এবং ২০১০ সালের জুলাই মাসে আমার ১৩ বছর বয়স হওয়ার সময়ই বৃষ্টিটা এলো। সাধারণত সোয়াতে বর্ষা আসে না এবং ফসল ভালো হবে ভেবে আমরা প্রথমে খুশিই হলাম। কিন্তু সেটা ছিল অবিশ্রান্ত এবং এত ভারী যে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকেই দেখা যেত না। পরিবেশবিদরা সতর্কবাণী দিয়েছিলেন যে আমাদের পর্বত থেকে তালেবান এবং কাঠ পাচারকারীরা গাছ কেটে ফেলেছে। শিগগিরই কাদা ভরা পানি নেমে এলো উপত্যকায়, জলজ্যান্ত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
বন্যা শুরুর সময় আমরা স্কুলে ছিলাম এবং আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এত পানি ছিল যে নোংরা জলাশয়টার ওপরের সেতুটা ডুবে গিয়েছিল ফলে আমাদের অন্য রাস্তা খুঁজতে হয়। পরবর্তী সেতুটাও ডুবে ছিল, কিন্তু পানি খুব গভীর না হওয়ায় আমরা পানির ভেতর দিয়েই গেলাম। বাজে গন্ধ ছিল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমরা সম্পূর্ণ ভিজে যাই এবং নোংরা হয়ে পড়েছিলাম।
পরদিন শুনলাম যে স্কুলে বন্যার পানি ঢুকেছে। পানি সরতে বহুদিন লাগল, আর ফেরার পর আমরা দেখলাম, দেয়ালে বুকসমান উঁচু বন্যার পানির চিহ্ন লেগে আছে। সবখানে কাদা আর কাদা। কাদায় টেবিল-চেয়ার ঢাকা ছিল। ক্লাসরুমের গন্ধটা খুবই বিরক্তিকর ছিল। এত ক্ষয়ক্ষতি হলো যে বাবার ৯০ হাজার রুপি খরচ করে মেরামত করতে হলো, এটি নব্বইজন শিক্ষার্থীর মাসিক ফিয়ের সমান।
পুরো পাকিস্তানেই একই চিত্র। হিমালয় থেকে কেপিকে এবং পাঞ্জাব হয়ে করাচি এবং আরব সাগরে বয়ে যাওয়া ইন্ডাজ নদী, যাকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেই ইন্ডাজ নদী এক ক্রোধোন্মত্ত জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে তীর ছাপিয়ে উঠে এসেছে। রাস্তা, শস্য এবং আস্ত আস্ত গ্রাম তালিয়ে গেছে। প্রায় দুই হাজার লোক ডুবে গেছে এবং ১৪০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। অনেকেই গৃহহারা হয়েছে এবং সাত হাজার স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। স্মরণকালের ভয়াবহতম বন্যা এটা। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন একে ‘ধীরগতির সুনামি’ বলে আখ্যা দিলেন। আমরা শুনলাম যে এশিয়ান সুনামি, আমাদের ২০০৫ সালের ভূমিকম্প, ক্যাটরিনা হারিকেন এবং হাইতির ভূমিকম্পের সম্মিলিত ক্ষতির চেয়েও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার একটা ছিল সোয়াত। উপত্যকার বেশিরভাগ অংশকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে বেয়াল্লিশটা সেতুর মধ্যে চৌত্রিশটাই ভেসে গেলে। বৈদ্যুতিক খুঁটি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ায় আমাদের বিদ্যুৎ ছিল না। আমাদের রাস্তাটাই ছিল এক পাহাড়ের ওপরে, তাই প্লাবিত নদীর রোষ থেকে আমরা কিছুটা নিরাপদ ছিলাম, কিন্তু গর্জনরত, ভারী নিশ্বাস নিতে থাকা, পথে যা পড়ে সব গ্রাস করে নিতে থাকা ড্রাগনের শব্দে শিউরে শিউরে উঠতে থাকলাম। নদীপাড়ের হোটেল, যেখানে পর্যটকরা টাকি মাছ খেতে খেতে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করত, সব ধ্বংস হয়ে গেছে। সোয়াতের পর্যটন এলাকাগুলোরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। মালাম জাব্বা, বাহরাইন ও মাদিয়ানের মতো হিল স্টেশন রিসোর্টগুলো বিধ্বস্ত, তাদের হোটেল এবং বাজারগুলোর ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল।
দ্রুতই আত্মীয়দের মাধ্যমে জানতে পারলাম, শাংলার ক্ষয়ক্ষতি অকল্পনীয়। আমাদের গ্রাম থেকে শাংলার রাজধানী আলপুরির রাস্তাটা ভেসে গেছে, আস্ত আস্ত গ্রাম জলমগ্ন, কার্শাত, শাহপুর এবং বার্কানার পাহাড়ি ঘরের সারিগুলো মাটিধসে ধ্বংস হয়েগেছে। মায়ের গ্রামের বাড়ি, যেখানে ফয়েজ মোহাম্মদ মামা থাকতেন, সেটা তখনো দণ্ডায়মান ছিল কিন্তু এর রাস্তাটা সম্পূর্ণ ভেসে গিয়েছিল।
মানুষ তাদের অবলম্বনগুলো রক্ষা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে, গবাদিপশুকে উঁচুতে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বন্যা তাদের শস্যকে শুষে ফেলেছে, ফলবাগান নষ্ট করে ফেলেছে, মহিষ ডুবিয়ে ফেলেছে। গ্রামবাসী সম্পূর্ণ অসহায়। তাদের কাছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। কারণ তাদের অস্থায়ী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। নদীটা ধ্বংসাবশেষ এবং বর্জ্যরে কারণে বাদামি হয়ে যাওয়ায় খাবার পানিও ছিল না। পানির তোড় এত শক্তিশালী ছিল যে কংক্রিটের দালান ধুলোয় পরিণত হয়েছিল। মেইন রোডে অবস্থিত স্কুলের হাসপাতাল এবং বিদ্যুৎ স্টেশন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
কেউ বুঝতে পারল না এটা কীভাবে ঘটতে পারে। সোয়াতের মানুষ তিন হাজার বছর ধরে এই নদীর পাড়ে থাকে, একে তারা সবসময় জীবনের জন্য হুমকি নয় বরং নির্ভরতা হিসেবে দেখে এসেছে এবং বাইরের দুনিয়া এই উপত্যকাকে স্বর্গ হিসেবেই দেখে এসেছে। আর এখন আমরা হয়ে গেছি ‘দুঃখের উপত্যকা’ আমার জ্ঞাতিভাই সুলতান রোমের ভাষ্যমতে। প্রথমে ভূমিকম্প, এরপর তালেবান, এরপর সামরিক অভিযান আর আমরা যখনই কেবল পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেছি তখনই বিধ্বংসী বন্যা এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মানুষ দুশ্চিন্তা করতে লাগল যে তালেবান গণ্ডগোলের সুযোগ নিয়ে আবারও উপত্যকায় ফিরে আসবে।
সোয়াত অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট স্কুলস এবং বন্ধুদের থেকে সংগ্রহ করা অর্থ দিয়ে বাবা শাংলায় ত্রাণ এবং সাহায্য পাঠালেন। আমাদের বন্ধু শিজা এবং ইসলামাবাদে পরিচয় হওয়া বেশি কিছু আন্দোলনকর্মী মিঙ্গোরায় এসে অনেক অর্থ সাহায্য বিতরণ করলেন। কিন্তু ঠিক ভূমিকম্পটার মতই ইসলামী দলগুলোই দুর্গম এলাকাগুলোয় সবার আগে স্বেচ্ছাসেবক পাঠাল। অনেকেই বলল যে গত কয়েকটা উৎসবে আমাদের করা নাচ-গানের বিরুদ্ধে এটা স্রষ্টার আরেকটা প্রতিবাদ। তবে এবারের সান্ত্বনাটা হলো যে এই বাণী ছড়িয়ে দিতে কোনো রেডিও ছিল না।
এই দুর্ভোগ যখন চলছে, মানুষ যখন তাদের প্রিয়জন, বাড়ি এবং জীবিকা হারাচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্রপতি আসিফ জারদারি তখন ফ্রান্সের গ্রামাঞ্চলের এক সামন্ত ভবনে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। ‘আব্বা, আমি বিভ্রান্ত,’ আমি বাবাকে বললাম। ‘ভালো কাজ করা থেকে প্রতিটা রাজনীতিবিদকে কিসে থামিয়ে দিচ্ছে? কেন তারা চায় না আমাদের মানুষ নিরাপদে থাকুক, খাবার এবং বিদ্যুৎ পাক? ইসলামী দলগুলোর পর মূল সাহায্য এলো সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। শুধু আমাদের সেনাবাহিনীই নয়, মার্কিনরাও হেলিকপ্টার পাঠাল, যা কিছু মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করল। একটা তত্ত্ব ছিল যে পুরো ধ্বংসলীলাটা সৃষ্ট হয়েছে আমেরিকানদের এইচএএআরপি (হাই-ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাকটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম) নামক প্রযুক্তির মাধ্যমে, যেটা সহাসমুদ্রের নিচে বিশাল ঢেউ তৈরি করে এবং যা আমাদের বন্যায় ভাসিয়েছে। তারপর, সাহায্য দেওয়ার নাম করে এসে তারা আইনসংগতভাবেই পাকিস্তানে ঢুকে আমাদের সব গোপন তথ্যের ওপর গোয়েন্দাগিরি করবে।
এমনকি বৃষ্টি সম্পূর্ণ থেমে যাওয়ার পরও জীবন খুব কঠিন হয়ে পড়ল। আমাদের বিশুদ্ধ পানি এবং বিদ্যুৎ ছিল না। আগস্টে মিঙ্গোরায় প্রথম কলেরা দেখা দিল এবং অতিদ্রুত হাসপাতালের বাইরে রোগীদের তাঁবু হতে গেল। সরবরাহের পথ বন্ধ থাকায় অল্পস্বল্প যা খাবার পাওয়া যেত, তা খুবই দামি ছিল। নাশপাতি ও পিঁয়াজের মৌসুম ছিল এবং কৃষকরা তাদের ফসল বাঁচাতে মরিয়া। অনেকেই কাদাভরা ফুলে থাকা নদীর ওপর রাবারের টায়ারে করে ঝঞ্ঝাটময় যাত্রা করে তাদের পণ্য বাজারে আনার চেষ্টা করল। কেনার মতো নাশপাতি পেয়ে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম।
অন্যান্য সময়ের চেয়েও কম বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গেল। পশ্চিমের ধনী দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দায় ভুগছিল, এবং প্রেসিডেন্ট জারদারির ইউরোপ ভ্রমণ তাদের সহানুভূতি আরো কমিয়ে দিল। অন্যান্য দেশের সরকাররা তুলে ধরল যে আমাদের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ আয়কর দেয় না, তাই চাপে পড়ে কর দেওয়া লোকজনকে তাদের দেশেই সাহায্য দিতে বলাটা বাড়াবাড়িই বটে তালেবানের এক মুখপাত্র দাবি করল যে ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের থেকে পাওয়া সাহায্য নিতে পাকিস্তান সরকারের অস্বীকৃতি জানাতে হবে, তাই বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো তাদের কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ল। ঠাট্টা করছে না, এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত। গত অক্টোবরে ইসলামাবাদে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম অফিসে বোমা বিস্ফোরণে পাঁচজন ত্রাণকর্মী নিহত হয়েছিলেন।
তালেবান যে একেবারেই যায়নি, সোয়াতে আমরা আবারও তার বিভিন্ন আলামত দেখতে লাগলাম। আরো দুটো স্কুল উড়িয়ে দেওয়া হলো এবং মিঙ্গোরায় মূল ক্যাম্পে ফেরার পর একটি খ্রিস্টান দলের তিন ত্রাণকর্মীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। আরো ভয়াবহ সংবাদ পেলাম। সোয়াত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, আমার বাবার বন্ধু ড. মোহাম্মদ ফারুককে দুজন বন্দুকধারী অফিসে ঢুকে হত্যা করেছে। ড. ফারুক ছিলেন ইসলামী পণ্ডিত এবং জামাআত-ই-ইসলামী দলের প্রাক্তন সদস্য এবং তালেবানের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে তিনি আত্মঘাতী হামলার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেন।
আমরা আবারও হতাশা এবং আতঙ্ক অনুভব করলাম। আইডিপি থাকা অবস্থায় ভাবছিলাম যে আমি বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হব, এখন বুঝতে পারছি, সিদ্ধান্তটা সঠিন ছিল। আমাদের দেশে এত সংকট কিন্তু তা সামাল দেওয়ার মতো কোনো সত্যিকারের নেতা নেই।