কৃপণ পিসি জব্দ
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের একজন বিধবা পিসি ছিলেন। পিসি নিঃসন্তান হলেও অগাধ বিষয়-সম্পত্তির মালিক। কিন্তু বুড়ি হাড় কৃপণ। বেশি খেলে পয়সা খরচ হবে, তাই কম খেত। একটা মাত্র ঝি তার দেখাশোনা করত।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একদিন গোপালকে বললেন, ‘গোপাল তুমি যদি আমার পিসির কাছ থেকে কিছু খসাতে পার-আমি তার দ্বিগুণ টাকা দেব। যতই ভুজং-ভাজং দাও, আমার পিসির কাছ থেকে একটা আধলাও বের করতে পারবে না।’
গোপাল বলল, ‘আমি পাথর টিপেও রস বার করতে পারি; আপনার টাকাওয়ালা পিসির কাছ থেকে নিশ্চয় টাকা খসাতে পারব।’
রাজবাড়ির সর্বত্রই গোপালের অবাধ গতি। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিশেষ প্রিয়পাত্র হওয়ায় বয়স্করা তাকে সবাই স্নেহ করত। গোপাল পিসিমার মহলের কাছে গিয়ে-‘পিসিমা’ ‘পিসিমা’ বলে ডাকতে লাগল।
-কে, গোপাল নাকি? কি মনে করে? এসো বাবা, বস বাবা, ভাল আছ তো?
গোপাল বলল- এমনিতে ভালোই আছি। গতকাল এক নামকরা গণক ঠাকুরকে হাত দেখিয়েছিলাম। সে বলল- আমার পরমায়ু আর মাত্র ছয় মাস।
-কী বলছ বাছা! এই কি তোমার মরবার বয়স?
গোপাল বলল,- বেশ নামকরা গণক ঠাকুর, অবিশ্বাসই বা করি কী করে? পিসিমা, অনেকদিন ধরেই মনের বাসনা ছিল, আপনার পাতের একটু প্রসাদ পাবার।
পিসিমা বললেন,- বেশ, তুমি কালই এখানে খেতে এসো।
-না না পিসিমা, আমি শুধু আপনার পাতের প্রসাদ পাব।
-বেশ, তাই হবে। তুমি কাল এসো।
গোপাল পরের দিন স্নান করে কিছু কুঁচো চিংড়ি ভেজে ট্যাঁকের মধ্যে কুঁচো চিংড়ি পুরে পিসিমার বাড়িতে চলে এলো।
-পিসিমা, আপনি আগে খেয়ে নিন, আমি আপনার এঁটো পাতেই খেতে বসব।
গোপাল খুবই নাছোড়বান্দা- অতএব পিসিমা নিরুপায়। পিসিমার এঁটো পাতেই গোপাল খেতে বসল। পাতে লাউঘণ্টও ছিল। গোপাল এক ফাঁকে ট্যাঁক থেকে কুঁচো চিংড়িভাজা বের করে লাউঘণ্টের সঙ্গে মিশিয়ে নিল।
অন্যান্য তরকারি দিয়ে খেতে খেতে মাঝে মাঝে একটু লাউঘণ্ট খেতে লাগল। দরজার পাশে ঝি দাঁড়িয়ে, পিসিমা তদারক করছেন।
-আর কিছু লাগবে গোপাল? নিরামিষ খেতে নিশ্চই তোমার কষ্ট হচ্ছে।
গোপাল বলল- কষ্ট হবে কেন, বেশ ভালোই হয়েছে। তা ছাড়া সবচেয়ে লাউ-চিংড়ি ঘণ্টটা বেশ ভালোই হয়েছে।
পিসিমা তো অবাক-কী বলছ গোপাল, ওটা তো শুধু লাউঘণ্ট!
গোপাল ঝিকে ও পিসিকে ডেকে দেখাল- এই তো চিংড়িমাছ রয়েছে। কত চিংড়ি!
পিসিমা বুঝতে পারলেন, এর পর আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি গোপালকে বললেন,- বুড়ো মানুষ, কী করতে কী করে ফেলেছি। এ কথা আর কাউকে বলো না বাবা, তাহলে আর আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না।
গোপাল বলল- ছয় মাস পরে মরতে চলেছি। কী করে আর মিথ্যা কথা বলি? আর রাজামশাই আমার অন্নদাতা-তিনি জিজ্ঞেস করলে আমাকে বাধ্য হয়ে সত্য কথাই বলতে হবে। তবে পিসিমা, আপনি ইচ্ছে করলে টাকা দিয়ে আমার মুখের কথা কিনে নিতে পারেন। ছয় মাস পরে যখন মরেই যাচ্ছি-আপনার অনুরোধে ছয় মাস না হয় মুখ বুজেই কাটিয়ে দেব। আপনি ঝিকেও কিছু টাকা দিন, ও যাতে কাউকে কোনো কথা না বলে। আর ছয় মাস যদি মুখ বুজে থাকি-আমার আয়-উপায় সবই বন্ধ হয়ে যাবে পিসিমা। ভাঁড়ের মুখ বন্ধ থাকলে কি উপায় আছে? তাই বলছিলাম যদি মোটামুটি অর্থাৎ হাজার পাঁচেক টাকা দেন, তবে আমি মুখ বুজে থাকতে পারি।
-পাঁচ হাজার! ওরে বাব্বা! অত হেঁকো না গোপাল, তাহলে তোমার আগেই আমি মারা যাব। আমি অত টাকা কোথায় পাব? আমি ৩০০ টাকা দিচ্ছি-আর ঝিকেও ৫০ টাকা দিচ্ছি-এতেই তোমরা একটু চুপ থেক।
পিসিমা সত্য সত্যই গোপালের হাতে ৩০০ টাকা এনে দিল।
গোপাল টাকাটা গুনে ট্যাঁকে গুঁজে নিয়ে বলল- খুবই কম হয়ে গেল পিসিমা। তবে আমি মারা গেলে আমার ছেলেপুলেদের একটু দেখবেন পিসিমা, তারা যেন একেবারে ভেসে না যায়।
-তা দেখব বৈকি বাবা।
গোপাল টাকাটা ট্যাঁকে গুঁজে সোজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে চলে এলো।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন- আমি তোমাকে ৬০০ টাকা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েই বসে আছি। পিসিমার ঘরে আড়ি পাতার জন্য লোক রেখেছিলাম, সে এসে আমাকে সব কথা বলেছে-আর কিছু বলতে হবে না। সত্যি গোপাল, তুলনা হয় না। অমন কিপটে পিসিমাকে তুমি নাজেহাল করে টাকা নিয়ে এলে?
গোপাল হেসে বলল- সেই জন্যই তো বেশি টাকা দাবি করিনি।
(সংগৃহীত)