ইফতার

‘তাবতারা মুর ঘী কা বারো মাসাল্লা’

Looks like you've blocked notifications!

ইফতার বাজার হিসেবে পুরান ঢাকার চকবাজারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ইতিহাস থেকে জানা যায়  শাহী মসজিদের সামনে একটি কূপ ছিল। তার চারপাশেই বিক্রি করা হতো ইফতারের বিভিন্ন উপকরণ। সময়ের  সাথে সাথে পুরান ঢাকার চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার তার আদি রূপ থেকে বর্তমান চেহারা ধারণ করেছে। ঐতিহ্য বজায় রেখে দোকানি আর ব্যবসায়ীরা প্রতিবছর রমজানে আনছেন নতুন নতুন ইফতার আয়োজন। যদিও  মূল আয়োজনটা চকবাজারকে ঘিরেই। এই বাজারের ইফতার সামগ্রীর প্রতি সব সময়ই বিশেষ আগ্রহ থাকে রোজাদারদের। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নানাপ্রকার আইটেম নিয়ে জমে উঠেছে এই ইফতার বাজার। চকবাজারে ইফতার কিনতে গেলে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হচ্ছে, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়।’রকমারি ইফতার বাজারের একটি জনপ্রিয় আইটেম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। ঐতিহ্যবাহী এই পদটি চলে আসছে যুগযুগ ধরে।

উৎপত্তি

এই জনপ্রিয় খাবারটি উৎপত্তিকাল পাওয়া যায়  সেই ব্রিটিশ  আমলে। এটি প্রায় ৭৫ বছর ধরে বিক্রি হয়ে আসছে। জানা যায়  কামেল মহাজন নামে একজন প্রথম এটি আবিষ্কার করেন। তিনি প্রথম নানা প্রকার মসল্লার সাথে মুরগি গরু ও অনেক কিছু মিশিয়ে এই খাবার তৈরি করেন। তার বানানো এই খাবার ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তিনি কাঁঠাল পাতার মোড়কে এটি বিক্রি করতেন। তারপর তার ছেলে জানে আলমের হাত ধরে এবং বংশানুক্রমে এখন তার দুই নাতি মো.  সালেকিন এবং মো.  হাসান এই মুখরোচক খাবার বিক্রি করছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় বর্তমানে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নাম হলেও এর আদি নাম ‘তাবতারা মুর ঘী কা বারো মাসাল্লা’। আগে খাটি গাওয়া ঘি দিয়ে বানানো হতো তাই এমন নাম। বর্তমানে গাওয়া ঘি অপ্রতুল হওয়াতে আর দেশ স্বাধীনের পর নাম পরিবর্তিত হয়ে যায়।

কী কী উপকরণ এবং কীভাবে  তৈরি করা হয়

এটি তৈরির সম্পূর্ণ রেসিপি পাওয়া যায় না। তবে কামেল মহাজনের নাতি সালেকিনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এটি তৈরিতে ডিম, গরুর মগজ, আলু, ঘি, কাঁচা ও শুকনো মরিচ, গরুর কলিজা, মুরগির মাংসের কুচি, মুরগির গিলা কলিজা, সুতি কাবাব, মাংসের কিমা, চিড়া, ডাবলি, বুটের ডাল, মিষ্টি কুমড়াসহ ১৫ পদের খাবার আইটেম ও ১৬ ধরনের মসলা প্রয়োজন। আর মোট ৩১টি পদের যে মিশ্রণ তৈরি হয়, তার নামই ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। একটি বড় গামলায় এই ৩১ ধরনের পদ হাতদিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে তারপর ঠোঙায় করে বিক্রি করা হয়। এটি কিনতে ছোট-বড় সব বয়সী রোজাদারের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি লেগে যায়।

কেবল এই আইটেমটির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ক্রেতারা ছুটে যান চকবাজারে। এখনো পুরান ঢাকার এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের এটি ছাড়া ইফতার জমে না, পূর্ণতা পায় না। তবে কয়েক বছর ধরে নতুন ঢাকার বাসিন্দারাও দিন দিন এই খাবারটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।

কীভাবে যাবেন  এবং কত দাম

এই বৃহৎ ইফতার বাজার বসে চক বাজার শাহী মসজিদের সামনের রাস্তায়। ঢাকা উত্তরের যেকোনো জায়গা থেকে প্রথমে বকশিবাজার মোড়ে আসুন। ওখান থেকে রিকশা ভাড়া ২৫ টাকা। যেকোনো রিকশা আপনাকে নিয়ে যাবে। আর ঢাকা দক্ষিণ থেকে আপনি রিকশা বা লেগুনা বা দূরত্বের ওপর নির্ভর করে হেঁটেও যেতে পারবেন।

বর্তমান দাম অনুযায়ী  প্রতি কেজি ‘বড় বাপের পোলায় খায়’-এর জন্য আপনাকে গুনতে হবে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা।

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

ইফতারের বাহারি সমারোহের জন্য চকবাজার যে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। বাঙালি সংস্কিৃতির সাথে মিশে গেছে এই ইফতারির মহাসমারোহ। মোগল রসুইখানার খাবারগুলো ঢাকার নবাবদের কল্যাণে আগেই ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে  গেলেও একমাত্র চকবাজারের কল্যাণেই সেসব খাবারের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাধারণ মানুষের।

নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ‘১৮৫৭ সালের আগেই চকবাজার জমজমাট হয়। সে সময়েই চকবাজারে গড়ে ওঠে নানা রকম মুখরোচক খাবারের দোকান। রোজার সময় মোগলাই খাবার এবং রকমারি ইফতার বিক্রি করা হতো এখানে।’

৭০ বছর বয়সী শরবত ব্যবসায়ী আহমেদ হোসাইন জানান, তার দাদার বাবাও এখানে রোজায় শরবতের ব্যবসা করেছেন। তাঁর হিসাবে, দেড়শ বছর ধরে চকবাজারে ব্যবসা করছে তাঁর পরিবার। একই রকম তথ্য দিলেন চকবাজারের ইফতার বিক্রেতা আবদুল কাহহার। তিনি জানান, ছয় পুরুষ ধরে বাজারে ইফতার ব্যবসা তাঁদের।

চকবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়,  ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় সুতি কাবাব (প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা), শাহী জিলাপি  (প্রতি কেজি ১৫০ টাকা), খাসির হালিম আকার ধরন ভেদে ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। খাসির রোস্ট  প্রতি পিছ ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে ডিম চপ, মুরগি ভাজা, মুরগির ফ্রাই,  লাবাং  ও হরেক  রকম আইটেম।