স্বামী-স্ত্রীর কেন ছাড়াছাড়ি হয়?
শুধু কি মানসিক বা শারীরিক সম্পর্কের কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়? অনেকেই হয়তো এই প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বলবেন। কিন্তু আজকাল বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা। যদিও এখন অনেক পরিবারে দুজনই উপার্জন করে এবং আর্থিক দিক থেকে দুজনই স্বচ্ছল থাকে। তবুও বিয়ের আগে আর্থিক অস্বচ্ছলতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে কেউ বলে না। এর ফলে পরে দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, অর্থনৈতিক কারণেই আজকাল বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে!
‘সম্পর্কে আর্থিক বিষয়টি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় যখন একজন জানে না, তার জীবনসঙ্গী টাকা দিয়ে কী করছে। এটা নতুন কিছু না এবং একেকজনের কাছে বিষয়টি একেক রকম’, বললেন অ্যাডভোকেট গীতা রমাসেসান। তিনি আরো বলেন, ‘এমন জটিলতায় মানুষ জড়িয়ে যাচ্ছে আজকাল, ক্রেডিট কার্ডের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ছে তারা। পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর ধরন দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে।’
অবশ্য সব মানুষ এক রকম হয় না। এ বিষয়ে গীতা বলেন, ‘কিছু মানুষ আছে যারা তাদের আয় সম্পর্কে বিয়ের আগে থেকেই জানিয়ে রাখে। অন্যদিকে বিবাহ ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, অনেকেই বিয়ের আগে নিজের আয়-উপার্জন সম্বন্ধে সঙ্গীকে পুরোপুরি ধারণা দেয় না, কারণ আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল মানুষকে কেউই বিয়ে করতে চায় না।’ নিজের আর্থিক দৈন্যদশার কারণেই সঙ্গীর কাছে, বিশের করে হবু স্ত্রীর কাছে নিজের আয়-রোজগারের বিষয়টি গোপন রাখে অনেকে।
‘অর্থ সম্বন্ধে মানুষের কিছু মিথ্যা ধারণাও আছে। এই যেমন কেউ কেউ আছে যারা কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কিন্তু তারা এটা ভাবে না যে এর ফলে ধীরে ধীরে তার ঋণের বোঝা বাড়ছে। আমি কয়েকজন মানুষকে চিনি যারা তিন থেকে চারটি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে অথচ তার সঙ্গী এই বিষয়ে কিছুই জানে না’, বললেন গীতা।
মানসিক ও সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বিজয় নাগাস্বামী বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমস্যা বর্তমানে অনেক বড় ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, কারণ মানুষ নিজের ভালো থাকার কথা আগে চিন্তা করে। মানুষ তার অর্থনৈতিক অবস্থার কথা লুকিয়ে রাখে। এর প্রধান কারণ হলো, সে চিন্তা করে যদি তার সঙ্গী তার অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা জানতে পারে, তাহলে সে তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিয়ে হওয়ার পর কয়েক বছর যেতে না যেতেই স্ত্রীরা যৌথ ব্যাংক হিসাব খোলার কথা বলতে শুরু করে।’ আর তখন থেকেই টানাপড়েন শুরু হয়। যেহেতু স্বামী আগে তথ্য গোপন করেছে, পরে যখন দেখা যায় সে মিথ্যা বলেছে, তখন স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়— এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
‘এই সমস্যা আসলে শহরেই বেশি দেখা যাচ্ছে, যেখানে মানুষ অনেক টাকা আয় করে’, বললেন অ্যাডভোকেট ভি কানাদেশান। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক সমস্যার একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, যেসব পুরুষ তাদের স্ত্রীর কাছ থেকে নিজের উপার্জনের কথা লুকায়, তারা আসলে গেজেট, কাপড় এবং ড্রিঙ্কসের পেছনে টাকা ব্যয় করে। কেউ কেউ বন্ধু, পার্টির পেছনে টাকা খরচ করে। গবেষণায় দেখা যায়, একজন পুরুষ তার আয় অনুযায়ী মাসে ২৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত মদের পেছনে ব্যয় করে। তাদের স্ত্রীরা এসব বিষয়ে জানতে পারে তখনই যখন তার স্বামীর বন্ধু তাকে জানায়। কিন্তু বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চায় স্ত্রী। এর কারণ বেশির ভাগ স্ত্রী গৃহিণী এবং পুরোপুরিভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল।’
কানাদেশান আরো বলেন, ‘কিছু কিছু ঘটনায় দেখা গেছে, অনেক সময় অর্থনৈতিক সমস্যার থেকে শারীরিক সমস্যা বড় হয়ে দাঁড়ায়। একটি ঘটনায় দেখা গেছে যে, একজন পুরুষ পরকীয়ার কারণে তার প্রেমিকার পেছনে সব টাকা ব্যয় করে অথচ স্ত্রীকে তেমন কোনো হাত খরচও দেয় না। সে তার স্ত্রীকে বলে, তার অফিস থেকে বেতন কেটে রেখেছে। এ রকম বেশ কয়েক মাস চলতে থাকলে তার স্ত্রীর সন্দেহ হয়। সে তার স্বামীর অফিসের কলিগের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর সে জানতে পারে, তার স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। পরে সে তার স্বামীর বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস জারি করে এবং বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে।’
এই সমস্যার জন্য যে শুধু স্বামীরাই দায়ী বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। অনেক সময় স্ত্রীর কারণেও বিচ্ছেদ ঘটে। অ্যাডভোকেট ভি কানাদেশান জানান, তার কাছে এমন ঘটনাও এসেছে, একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে শুধু তার ক্রেডিট কার্ডের বিলের জন্য! পোশাক, মেকআপ ও পার্টি বাবদ তার স্ত্রী সাড়ে তিন লাখ টাকা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে খরচ করেছে। সে দেশের বাইরে থাকে এবং এই বিল শোধ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কার্ড কোম্পানি তার অফিসে যোগাযোগ করে। এর ফলে সে তার চাকরি হারায়। তাকে দেশে ফেরত আসতে হয় এবং দেশের বাড়ির জমি বিক্রি করে তাকে সেই বিল পরিশোধ করতে হয়।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আর্থিক বিষয়ে অস্বচ্ছতাই বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান কারণ। অ্যাডভোকেট গীতা বলেন, ‘প্রায়ই দেখা যায় ক্রেডিট কার্ড সংক্রান্ত ঝামেলায় স্বামীরা জড়িয়ে পড়েন এবং এ কারণে ব্যাংকের লোক বাসায় এসে হুমকি দেওয়া শুরু করে এবং পুরো পরিবার অনিশ্চয়তায় ভোগা শুরু করে। স্ত্রীরা চিন্তা করে এভাবে সংসার করা তার পক্ষে সম্ভব না এবং এটি তার সন্তানের জন্যও ক্ষতিকর।’
পরিবার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্রিন্দা জয়ারামান মনে করেন, বিয়ের আগে অবশ্যই দুজনের আর্থিক বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা করা উচিত। ‘যখন আমি কোনো দম্পতির সঙ্গে দেখা করি, আমি চার ধরনের সমস্যা দেখতে পাই, ১. সম্পর্ক- যেখানে একজন ভেবে নেয় যে তার সঙ্গীর আবেগ অনেক কম, ২. শারীরিক সম্পর্ক, ৩. পরকীয়া এবং ৪. আর্থিক অবস্থা’, বললেন ব্রিন্দা জয়ারামান। তিনি আরো বলেন, ‘যদি এই চার সমস্যার মধ্যে কোনো একটি সমস্যা দম্পতির মধ্যে থাকে তাহলে একটা সময় সেটি বিচ্ছেদে গিয়ে শেষ হয়।’
দাম্পত্য এই সংকট রোধে সমাধান কী হতে পারে, এ বিষয়ে ব্রিন্দা বলেন, ‘যদি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চান তাহলে কীভাবে এই অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করবেন সেই চিন্তা করুন। পরকীয়া করা বা নেশায় জড়িয়ে পড়া কোনো সমাধান হতে পারে না। একমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতিই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে।’ অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হলেই যে দাম্পত্য সংকট দূর হবে তা নয়, কারণ অনেকের অর্থ থাকা সত্ত্বেও বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এক সংকট রোধে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা ভীষণ জরুরি।