যেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় ‘জেলের ভাত’ খাচ্ছে!
‘কারাগার’ শব্দটি শুনে পিলে চমকে ওঠে না, এমন মানুষ নিশ্চয়ই বিরল। তোকে জেলের ভাত খাওয়াব—এমন হুমকি শোনার পর হাঁটু কাঁপবে না, এমন মানুষ পাওয়াও ভার। তবে সেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন। সঙ্গী হচ্ছেন প্রিয়-প্রেয়সী। খাচ্ছেন ‘জেলের ভাত’। হাসিমুখে মেনে নিচ্ছেন ‘কারাদণ্ড’। রসিকতা ভাবছেন? মোটেও কৌতুক নয়। সত্যিই এমনটা ঘটছে। আর তাও রাজধানী ঢাকাতেই।
হ্যাঁ, স্বেচ্ছায় জেলের ভাত খেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে উত্তরার জেল ক্যাফেতে। সেখানে খাকি পোশাকে হাজির হবেন ওয়েটার। তাঁর কোমরে পিস্তল উঁকি দিলেও হাসিমুখে আপনার কাছে জানতে চাইবেন—কেমন কারাদণ্ড পছন্দ আপনার? আপনিও সানন্দে তাঁকে উত্তর বাতলাবেন। চেখে দেখতে চাইবেন কারাদণ্ড!
শুধু কি তাই? চেয়ারে বসে উপরের দিকে তাকালে কখনো চোখে পড়বে ফাঁসির রশি ঝোলানো। মনে হবে, ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে শেষবার তৃপ্তি করে খেয়ে নিই! হ্যাঁ, তবে ভয়েভয়ে নয়, সানন্দে। এমন সব মজার কাণ্ড ঘটছে ওই রেস্তোরাঁয়। পুরো নাম ‘সেন্ট্রাল জেল ক্যাফে’।
গেল ৬ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হলেও কারাগারের আদলে গড়া ওই রেস্তোরাঁয় এখন উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। রটে গেছে ক্যাফেটির নাম।
কারাগারে যেমন সেল রয়েছে, ওই রেস্তোরাঁয়ও আছে তিনটি। সেল নাম্বার—৪২০, ০০৭ ও ৭৮৬। খাবারের মেন্যু সাজানো হয়েছে চার ধাপে—কারাদণ্ড-১, কারাদণ্ড-২, কারাদণ্ড-৩ ও কারাদণ্ড-৪। মজা এখানেই। খেলেই কারাদণ্ডের স্বাদ—কী অদ্ভুত আইডিয়া!
ব্যতিক্রমী ধারণা ও সজ্জার এই ক্যাফের উদ্যোক্তা দুই বন্ধু ফজলে রাব্বি ও জাকির হোসেন। ঢাকার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে রেস্তোরাঁ খুলেছেন তাঁরা। সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনকে তাঁরা জানালেন তাঁদের রেস্তোরাঁর নানা অজানা।
সেল ৪২০
এই সেলের জানালায় চোখ রাখলে শহরের রোদ আপনাকে যেমন আমন্ত্রণ জানাবে, তেমনি বৃষ্টির দিনে মেঘলা আকাশ মন ভেজাবে। এই সেলের বিশেষত্ব, এটি যুগলদের। প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী এখানে চুটিয়ে খোশগল্প করতে পারবেন। তবে এই সেলে ঢুকতেই চোখে পড়বে কিছু সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা—‘পালাবি কোথায়’, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিব না’ কিংবা ‘পুলিশ চারদিক থেকে ঘিরে ফিলেছে’। বাণী পছন্দসাপেক্ষে সাইনবোর্ড হাতে নিয়ে তুলতে পারবেন সেলফিও।
সেল ০০৭
জনপ্রিয় ব্রিটিশ উপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের কাল্পনিক চরিত্র জেমস বন্ডের কথা কারো অজানা নয়। ০০৭, এই সাংকেতিক নম্বরটি জেমস বন্ডের। আর এই সাংকেতিক নম্বরটি মাথায় রেখেই এই সেলের নামকরণ করা হয়েছে। এখানে পরিবারের সবাই ও বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতে পারবেন। আসবে জেমস বন্ডের মতো ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। যে কোনো পার্টির জন্য এই সেল সেরা। জন্মদিনের কেক কাটার জন্য এই সেল বেছে নেন অনেকেই।
দেখুন ভিডিওতে :
সেল ৭৮৬
সিনেমায় ডনদের দেখে অনেকেই মনে মনে ভাবেন, ‘ইশ! একদিনের জন্য যদি ডন হতে পারতাম!’ এই সেলে বসে আপনি নিজেকে ‘মাফিয়া ডন’ ভাবতে পারবেন। সেরকম একটা বড় চেয়ারও রাখা আছে এখানে। পাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি খেলনা পিস্তল। চেয়ারে বসে কালো চশমা পরে ‘ডন লুক’ দিয়ে পিস্তল হাতে অনায়াসে বিভিন্ন ভঙ্গিতে তুলতে পারবেন সেলফি। এই সেলের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা—‘সশ্রম কারাদণ্ড ঘর’, ‘আমি জেল থেকে বলছি’, ‘জেল থানায় সম্বল, কাঁথা বালিশ কম্বল’। তবে ভোজনরসিক ডনদের আয়েশের জন্য সেখানে এখনো বালিশ রাখা হয়নি। ভবিষ্যতে থাকতেও পারে।
ওয়েটারের পোশাক
জেলের ভেতর একটু অন্যরকমভাবে খাবার পরিবেশন করা হয়। আর এই পরিবেশ তৈরির জন্যই খাকি পোশাকে তিনজন ওয়েটার ক্যাফেতে খাবার পরিবেশন করেন। তাঁদের কোমরে রয়েছে খেলনা পিস্তলও। আপনার কি মনে পড়ে, কখনো কোনো রেস্তোরাঁর ওয়েটারের সঙ্গে ছবি তুলেছেন? মজার ব্যাপার হলো, এই ক্যাফের ওয়েটারদের সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য উন্মুখ অনেক ভোজনরসিক।
খাবারের মেন্যু
এবার চলুন দেখি, ক্যাফের খাবারের মেন্যুতে কী কী আছে। কফি থেকে শুরু করে স্যুপ, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান ও দেশি সব ধরনের খাবার এখানে পাওয়া যায়। খেয়ে আত্মহত্যা করতে চান? সেই খাবারও আছে, নাম ‘সুইসাইড উইংস’। যাঁরা কড়া ঝালপ্রিয়, তাঁদের জন্যই এ খাবার।
দুপুরের খাবারের মেন্যু যখন আপনার হাতে তুলে দেওয়া হবে, তখন দেখতে পাবেন মেন্যুপেপারে লেখা—কারাদণ্ড-১, কারাদণ্ড-২, কারাদণ্ড-৩ ও কারাদণ্ড-৪। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত এই মেন্যুর খাবারগুলো পাওয়া যাবে।
কারাদণ্ড-১, ২৫০ টাকা : মুরগির ঝোল, আলু ভর্তা, আচার, শাক, বেগুন ভাজি, ডিম ভাজি, সবজি, ডাল, সালাত, সাদা ভাত, পানি।
কারাদণ্ড-২, ৩০০ টাকা : গরুর কালাভুনা, আলু ভর্তা, আচার, শাক, বেগুন ভাজি, ডিম ভাজি, সবজি, ডাল, সালাদ, সাদা ভাত, পানি।
কারাদণ্ড-৩, ২৩০ টাকা : তেলাপিয়া মাছ ভাজি, আলু ভর্তা, আচার, শাক, বেগুন ভাজি, ডিম ভাজি, সবজি, ডাল, সালাদ, সাদা ভাত, পানি।
কারাদণ্ড-৪, ৩০০ টাকা : ইলিশ মাছ ভাজি, আলু ভর্তা, আচার, শাক, ডিম ভাজি, সবজি, ডাল, সালাদ, সাদা ভাত, পানি।
কন্টিনেন্টাল আইটেমও আছে অনেক। এর মধ্যে আছে চিকেন স্টিক, লেমন গারলিক চিকেন, ক্যারোলিনা চিকেন, বিফ ইস্টার, হোয়াইট স্পাইস পাস্তা, থাই স্যুপ, কর্ন স্যুপ, টম ইয়াম, স্যুপ, সি-ফুড স্যুপ, সুইসাইড ব্লাস্ট চিকেন বার্গার, সুইসাইড উইংস। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের সালাদ, জুস ও পানীয় রয়েছে।
স্বাধীনতার জানালা
ক্যাফের দক্ষিণে একটি বারান্দা, জানালাও রয়েছে। সেই জানালার নাম রাখা হয়েছে ‘স্বাধীনতার জানালা’। খেতে খেতে যদি ক্লান্তি অনুভব করেন, তাহলে জানালা দিয়ে তাকালেই চোখ জুড়াবে।
জেলের গান
জেমসের ‘জেল থেকে বলছি’ গানের সঙ্গে কম-বেশি সবাই পরিচিত। ক্যাফেতে গেলে এই গান শুনতে পাবেন। এ ছাড়া পথিক নবীর ‘মাক্ষি গিরা গরম’ গানটিও শোনা যাবে। পথিক নবীর গানটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নাকি এই ক্যাফে করার কথা মনে আসে উদ্যোক্তাদের। তবে বাস্তবে কখনো কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা হয়নি তাঁদের।
গুন্ডা-গুন্ডি
সাধারণত যেকোনো রেস্তোরাঁয় পুরুষ ও নারীর জন্য আলাদা ওয়াশরুম থাকে। ওপরে লেখা থাকে ‘লেডিস’ ও ‘জেন্টস’। এখানেও রয়েছে। তবে চমক রয়েছে নামে। সেখানে পুরুষ ও নারীর জন্য ওয়াশরুমের নাম যথাক্রমে ‘গুন্ডা’ ও ‘গুন্ডি’।
বাড়ছে ভোজনরসিকদের ভিড়
মাত্র এক মাসেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই রেস্তোরাঁ। উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গরিবে নেওয়াজ অ্যাভিনিউ রোডে এই ক্যাফে অবস্থিত। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত এই ক্যাফে খোলা থাকে। ঢাকার বাসিন্দা ছাড়াও কেরানিগঞ্জে ও চট্টগ্রাম থেকে শুধু এই ক্যাফেতে খাওয়ার জন্য ভোজনরসিকেরা এসেছেন বলে জানা যায়। ফেসবুক পেজ থেকে তাঁরা জেনেছেন এই রেস্তোরাঁর খবর।
তবে ঢাকায় জেল ক্যাফে নতুন হলেও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের ক্যাফে রয়েছে। উদ্যোক্তারা জানালেন, মুম্বাই ও কলকাতায় নাকি এ ধরনের রেস্তোরাঁ আছে। ইউটিউবে সেসব ক্যাফের সাজসজ্জা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁরা।