আগে ‘না’, ভিডিও আছে শুনে ‘হ্যাঁ’!
শরীয়তপুরে ইজিবাইককে ধাক্কা দেওয়ার প্রতিবাদ করায় র্যাব সদস্যরা স্পেন প্রবাসী এক যুবককে আটক করে নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আটকের পরপর সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে র্যাব অস্বীকার করে। পরে এই ঘটনায় ক্লোজড সার্কিট (সিসি টিভি) ক্যামেরার ফুটেজ থাকার কথা জানালে র্যাব দাবি করে, ওই প্রবাসীর প্যান্টের পকেটে ইয়াবা ও জাল নোট পাওয়া গেছে। পরদিন মামলা দিয়ে এজাহারে বলা হয়, ওই প্রবাসী দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় র্যাব সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়েছেন।
নির্যাতনের শিকার ওই যুবকের নাম শামীম শিকদার। তাঁর বিরুদ্ধে সদরের পালং মডেল থানায় মামলা করেছে র্যাব। শামীম শরীয়তপুর পৌরসভার তুলাসার এলাকার খালেক শিকদারের ছেলে। তিনি ১৫ বছর ধরে স্পেন প্রবাসী।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে শরীয়তপুর শহরের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সামনে দিয়ে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন সাদা পোশাকে থাকা র্যাব সদস্যরা। এ সময় মোটরসাইকেল চালক মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ মোটরসাইকেলটি একটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইককে ধাক্কা দেয়।
ইজিবাইকের যাত্রী শরীয়তপুর জজকোর্টের রাষ্ট্রপক্ষের সহকারী কৌঁসুলি (এপিপি) পারভেজ রহমান জন ও স্থানীয় কয়েকজন যুবক ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এর জের ধরে সন্ধ্যা ৫টা ৫৪ মিনিটে শহরের রাজগঞ্জ ব্রিজ এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে আট-দশজন লোক প্রতিবাদকারীদের একজন স্পেন প্রবাসী শামীম শিকদারকে সবার সামনে মারধর করে তুলে নিয়ে যান।
রাত ১০টা পর্যন্ত তাঁর পরিবারের সদস্য, স্থানীয় থানা ও গণমাধ্যম কর্মীরা মাদারীপুর যোগাযোগ করলে র্যাব ক্যাম্পের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শামীম শিকদার নামের কাউকে তারা আটক করেনি।
পরে রাজগঞ্জ ব্রিজ এলাকার একটি ক্লোজড সার্কিট (সিসি টিভি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে গণমাধ্যমকর্মীরা নিশ্চিত হন, র্যাব সদস্যরা শামীমকে তুলে নিয়েছেন। এরপর বিষয়টি মাদারীপুর র্যাব ক্যাম্পে জানানো হয়। কিছুক্ষণ পরে সাংবাদিকদের কাছে এসএমএস পাঠিয়ে র্যাব জানায়, শামীম শিকদারকে ইয়াবা ও জাল টাকাসহ আটক করা হয়েছে।
এর পরদিন শুক্রবার র্যাব ৮-এর উপসহকারী পরিচালক শহীদুল ইসলাম বাদী হয়ে শরীয়তপুর সদরের পালং মডেল থানায় শামীম শিকদারকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ওই প্রবাসী দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় র্যাব সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। এতে র্যাবের এক সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁকে আটক করে ক্যাম্পে আনা হলে তাঁর প্যান্টের পকেটে ১০০টি ইয়াবা ও ১০ হাজার টাকার জাল নোট পাওয়া যায়।
যোগাযোগ করা হলে শামীমের মা সালেহা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে ১৫ বছর ধরে স্পেন থাকে। র্যাব সদস্যরা অহেতুক তাকে ধরে নিয়ে অমানবিক অত্যাচার করে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমি মিথ্যা মামলার বিচার চাই।’
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শরীয়তপুর জজকোর্টের এপিপি পারভেজ রহমান জন বলেন, ‘বিকেল ৪টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে তিন ব্যক্তি (সাদা পোশাকে র্যাব সদস্য) যাচ্ছিল। চালক মোবাইল ফোনে কথা বলছিল। এমন অবস্থায় তারা একটি ইজিবাইককে ধাক্কা দেয়। আমরা বিষয়টির প্রতিবাদ করি। তখন সেখানে উপস্থিত শামীম শিকদারও প্রতিবাদ করেন। রাত ৮টার দিকে খবর পাই, র্যাব পরিচয়ে শামীমকে তুলে নেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি থানায় ছুটে যাই। র্যাব ক্যাম্পে যোগাযোগ করি। রাত ১০টা পর্যন্ত কেউ শামীমের সন্ধান দিতে পারেনি। তখন আমি রাত ৯টার দিকে পালং থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি।’
পরে এপিপি খবর পান, র্যাব সদস্যরা শামীমকে পালং থানায় সোপর্দ করে মামলা দিয়েছেন।
শুক্রবার সকালে পালং থানায় বসে শামীম শিকদার বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ধরে স্পেনে আছি। ৬ ডিসেম্বর দেশে আসি। আগামী মাসে ফিরে যাওয়ার কথা। বৃহস্পতিবার বিকেলে র্যাবের তিন সদস্যের সঙ্গে কথাকাটাকাটির জের ধরে আমাকে আটক করে মারধর করা হয়েছে। রাতে ক্যাম্পে নিয়ে আমার চোখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। ইয়াবা ও জাল টাকা দিয়ে এখন আমাকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’
পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান বলেন, শুক্রবার সকালে র্যাব এক যুবককে থানায় নিয়ে আসে। তাঁর সঙ্গে ১০০টি ইয়াবা ও ১০ হাজার টাকার জাল নোট পাওয়া গেছে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগের একটি এজাহার দিয়েছে র্যাব। শামীম শিকদারের বিরুদ্ধে মাদক বা অন্য কোনো মামলা ওই থানায় নেই বলে জানান ওসি।
র্যাব ৮-এর মাদারীপুর ক্যাম্পের পরিচালক মেজর সোহেল রানা বলেন, শামীম নামের ওই যুবক মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় র্যাব সদস্যদের ওপর হামলা চালান। তাতে একজন র্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁকে আটক করে ক্যাম্পে আনা হলে তাঁর প্যান্টের পকেটে ১০০টি ইয়াবা ও ১০ হাজার টাকার জাল নোট পাওয়া যায়। তাঁকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি।
এদিকে সিভিল সার্জন কার্যালয় এলাকা ও রাজগঞ্জ ব্রিজ এলাকার একাধিক দোকানি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শামীম শিকদার কোনো র্যাব সদস্যের ওপর হামলা চালাননি। বরং র্যাব সদস্যরাই তাঁকে মারতে মারতে নিয়ে যান।