ঈদ
যে কারণে ছুটি বাড়ির পানে
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার, পথ দেব পাড়ি তোমার/কাছে যাব ফিরে বারে বার- একটি মুঠোফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনচিত্রে ব্যবহৃত এই গানটি যেন এখন বাংলাদেশের মানুষের মুখে মুখে। কারণ সারা বছরের দিন গোনা শেষে এখন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো নাড়ির টানে পাড়ি জমাচ্ছেন শৈশবের স্মৃতিময়তার ভিটায়। সড়ক, নৌ, রেলপথ—সব পথ দিয়েই বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে লাখ লাখ মানুষ। তাদের চঞ্চলতায় সব টার্মিনাল এখন সরগরম। অনেক আগেই শুরু হয়েছে টিকেট সংগ্রহ। দিন-রাত লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করা টিকেটটি পকেটে পুরে, নতুন পোশাক ব্যাগবন্দি করে, চোখভরা আনন্দ নিয়ে নিজ বাড়ির পানে পাড়ি জমাচ্ছেন তাঁরা। যাঁরা এখনো ঘরে ফেরার টিকেটটি হাতে পাননি, তাঁদের চেষ্টা চলছে অবিরাম।
উন্নত জীবিকা, পড়ালেখাসহ আরো অনেক কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে হয়েছে শহরমুখী। শহরকে কেন্দ্র করেই তাদের আগামী দিনের সব পরিকল্পনা। তবু বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে নাড়ির টানে এসব মানুষের মধ্যে তৈরি হয় ঘরে ফেরার তাগাদা। মা-বাবা, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবসহ শৈশবের ফেলে আশা দিনগুলো স্মৃতির বারান্দায় পায়চারি করেন তাঁরা। তাই সবাই ফিরে যায় নিজ শিকড়ে, আপন গ্রামে। আর কদিন পরই ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে গ্রামে যেতে চাইবে অসংখ্য শহরবাসী। স্টেশনেই রাত কাটিয়ে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষায় থেকে অধরা টিকেটখানা হাতে পেয়ে যে হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখতে পাচ্ছি আমরা, তা দেখে মনে হয় সত্যিই এ ফেরা নাড়ির টানে ফেরা। বছরের অন্যান্য সময়ে বাড়ি যাওয়ার চেয়ে ঈদে বাড়ি যাওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য। কত কত আবদার, বায়না আর আশা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। মা-বাবা, ছোট ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই হয়তো বিভিন্ন আঙ্গিকে আপনাকে চাইছে, আপনি কবে ফিরবেন? আপনিও চাইছেন সব ঝামেলা শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যেতে। কেন এত কষ্ট সহ্য করে বাড়ি ফেরা? উত্তরে বিভিন্ন কথা আসতে পারে। যেমন মা-বাবা গ্রামে থাকেন, পরিচিত পরিবেশে ভালো লাগে সবার সঙ্গে ঈদ করতে ইত্যাদি। কিন্তু একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাব ভিন্ন একটি কারণ।
নগরায়নের প্রভাবে আমাদের গ্রামগুলো ধীরে ধীরে শহর কিংবা শহরের মতো হয়ে উঠছে সত্য। তবে বাঙালি জাতির মূল ভিত ও পরিচয় গ্রামীণ জনপদ ও তার জীবনযাপন। ফলে গ্রামে যাওয়ার এসব উপলক্ষকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। ঈদ বলি আর পূজা বলি, সব ধরনের উৎসবকেন্দ্রিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির সংস্কৃতি আমাদের ঐতিহ্যেরই অংশ। এ কারণেই হয়তো শহরের কৃত্রিম জীবনযাপনে অস্থির মানুষ ফিরে যেতে চায় নাড়ির টানে।
অনেকেই অল্প টাকার চাকরি করেন। ফলে সাধ্যের মধ্যে বাড়ির সবার জন্য জামা-কাপড়সহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই কিনতে হয়। ঈদের বোনাস তাই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দ পুরোপুরিই ভেস্তে যাবে যদি বোনাস না পাওয়া যায় সময়মতো। প্রিয়জনদের সঙ্গে বছরের এই সময় দেশের বাইরে থেকে অনেকে আসেন ঈদ উদযাপন করবেন বলে। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে হাড়ভাঙা খাটুনিতে উপার্জন করে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন তারা। আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করতে তাদের অবদানকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না কখনো। পরবাসে থেকে দেশে ফিরে এলে তাঁরাও চান আনন্দের এই ক্ষণগুলো উপভোগ করতে।
ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানেই অনাবিল আনন্দ। এ সময় কাছে দূরে যে যেখানেই থাকুক না কেন ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে তারা ফিরে চলে আপন ঠিকানায়। অনেকের কাছে তাই ঈদ মানেই ইট-পাথরের শহর ছেড়ে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরে চলার আনন্দ। বিশেষ করে ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে এই অপেক্ষাটা একটু বেশি থাকে। ঈদের ছুটির দিনক্ষণ কবে ঘোষণা হবে সেই জন্য উতলা মন নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী। আর যখন সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত ছুটির সন্ধান মেলে তখন শুরু হয়ে যায় বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি। মূলত তখন থেকেই তাদের মনের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ঈদের আনন্দ। টিকেট কাটা থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড় গুছানো সবকিছুতেই তখন বিরাজ করে উৎসব উৎসব আমেজ।
ঈদের আগে রাস্তার সীমাহীন যানজট, টিকেটের ভোগান্তি, অতিরিক্ত ভাড়া, যানবাহনগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় এ রকম হাজারো প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে সবুজ শ্যামল গ্রামের বাড়ির দিকে ছুটে চলে তারা। মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে ভাবনার চাকা। ইস! কতদিন পর সবার সঙ্গে দেখা হবে। সেই শৈশব-কৈশোরের ফেলে আসা দিনগুলোতে যারা সব সময় পাশে ছিল, সেই বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হবে। কত কথাই না বলার আছে তাদের সঙ্গে। ক্যাম্পাসের কথা, নতুন নতুন বন্ধুদের কথা। আরো কত মজার মজার অভিজ্ঞতাই না জমে আছে গল্পের ঝুলিতে।
যেসব শিক্ষার্থীরা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে তাদের কাছে গ্রামে যাওয়ার আনন্দটাই অন্যরকম হয়ে দেখা দেয়। ইট-কাঠের ঢাকা শহরে সবুজের দেখা পাওয়াটা দুরূহ ব্যাপার হলেও তাদের মনে তখন দোলা দিয়ে যায় গাঁয়ের অবারিত সবুজের মাঝে মেঠোপথের ধারে গজিয়ে ওঠা কোমল সবুজ দূর্বাঘাসের ডগায় ভোরের শিশিরকণা। সেই সবুজ দূর্বাঘাসের নরম কার্পেটে খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার অনুভূতি। শহরে বিদ্যুতের ঝলমলে আলোয় রাতের প্রকৃত যে সৌন্দর্য তা ছাপিয়ে মনের কোণে দোলা দিয়ে যায় গাঁয়ের খোলা আকাশের নিচে ঝিরিঝিরি বাতাসে চুল উড়িয়ে জোৎস্নার অপার্থিব সৌন্দর্য দেখার দৃশ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন, ডাইনিং আর মেসের রান্না করা খাবার খেতে খেতে বিরক্ত মনগুলো তখন উতলা হয়ে ওঠে মমতাময়ী মায়ের হাতে রান্না করা অসাধারণ সব খাবারের জন্য। ক্লাস, পরীক্ষা, এসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশনের সব চিন্তা তখন যেন কোথায় হারিয়ে যায়। ঈদে বাড়ি ফেরার এই আনন্দ যেন ঈদের আগে হয়ে ওঠে আরেক ঈদ!
মায়া-মমতা-আবেগ-অনুভূতিতে ভরা বাঙালি হৃদয় সর্বদাই ঘরমুখী। দুয়ারে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছে যে প্রিয়জনকে রেখে জীবিকার খোঁজে এসেছিল এই শহরে, আজ ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে চিরচেনা সেই স্বজনদের মাঝে উপস্থিত হওয়ার আকুলতা তাই সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে কর্মস্থলকে পেছনে ফেলে, নাড়ির টানে সম্মুখপানে টেনে নিচ্ছে সবাইকে। নাড়ির টানে আশৈশব কাটানো স্বজন-বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে মিলনের জন্য গ্রামের বাড়িতে শত দুর্ভোগ সত্ত্বেও যাওয়ার জন্য মানুষ উতলা হয়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার এই ব্যাকুলতা রুখে দেওয়ার সাধ্য কার!
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।