‘আমরা খুশি, বাবা তাঁর যোগ্য স্থান পেয়েছেন’
‘দেশের মানুষ বাবাকে কতটা ভালোবাসে, আমি তা নিজের চোখে দেখেছি। বাবাও সারা জীবন সম্মানের সঙ্গে জীবন কাটতে চেষ্টা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাবার কবরের বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের পাশে স্থান করে দিয়েছেন। আমরা অনেক খুশি, বাবা তাঁর যোগ্য স্থান পেয়েছেন। সবাই দোয়া করবেন, যেখানেই থাকেন, বাবা যেন ভালো থাকেন।’
গতকাল বুধবার এভাবেই বলেন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছেলে আসিফ ইমতিয়াজ। গতকাল নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার ঘণ্টা পর মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতজ্ঞ বুলবুলকে। বুলবুলের পরিবারের দাবি ছিল, তাঁকে যেন বুদ্ধিজীবীদের পাশে দাফন করা হয়। কিন্তু বিকেলে খোঁড়া কবরটি বুদ্ধিজীবীদের কবরের পাশে ছিল না। এতেই ক্ষুব্ধ হয় তাঁর পরিবার।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে প্রখ্যাত এই সংগীত পরিচালককে বুদ্ধিজীবীদের কবরের পাশেই দাফন করা হয়।
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করতে পেরে খুশি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের পরিবার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁরা। মাগরিবের আজানের আগে যখন কবর খোঁড়া হচ্ছিল, তখন পাশেই ছিলেন বুলবুলের ছেলে ও বোনরা। চোখে-মুখে এক ধরনের তৃপ্তি। বিদায়টা বেদনার, কিন্তু আছে যে স্বীকৃতির আনন্দ।
বিকেল ৩টার সময় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। কবর আগে থেকেই খোঁড়া ছিল কবরস্থানের উত্তর পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে। পূর্বপাশে ছিল বুদ্ধিজীবীদের স্থান। কবর দেখেই মন খারাপ করেন বুলবুলের ছোট বোন রোকসানা ও ছেলে আসিফ ইমতিয়াজ। প্রতিবাদ করতে থাকেন উপস্থিত সবাই। বুদ্ধিজীবীদের পাশে স্থান না পেলে আজিমপুর কবরস্থানে লাশ নিয়ে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। এ অবস্থায় কেটে যায় একটি ঘণ্টা। তখন বিকেল ৪টা।
মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ জালাল (যিনি বিচ্ছু জালাল নামেই বেশি পরিচিত) ও সংগীত পরিচালক মকসুদ জামিল মিন্টু বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেন সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে। বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে বুদ্ধিজীবীর পাশে জায়গা পেতে হলে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ অনুমতি দিতে পারেন না বলে জানান তাঁরা। শুরু হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। চারদিকে তখন থমথমে অবস্থা। প্রতিবাদ করছে সবাই। বুদ্ধিজীবীদের পাশেই জায়গা হতে হবে বুলবুলের। এভাবেই কেটে যায় আরো এক ঘণ্টা।
জহির উদ্দিন মোহাম্মদ জালাল ও মকসুদ জামিল মিন্টু প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাড়ে ৫টায় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানতে পারেন এবং বুদ্ধিজীবীদের পাশে কবর দেওয়ার অনুমতি প্রদান করেন। পরে বুলবুলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ১ নম্বর গেটে। শুরু হয় কবর খোঁড়া।
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান জামে মসজিদে তৃতীয় জানাজা পড়ানো হয় বাদ মাগরিব। সন্ধ্যা ৭টার সময় দাফন করা হয় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে।
বিষয়টি নিয়ে বুলবুলের ছোট বোন রোকসানা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা অনেক খুশি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। আমার ভাই তাঁর যথাযথ সম্মানটুকু পেয়েছে। সারা জীবন দেশের জন্য কাজ করে গেছে, তার প্রতিদান পেয়েছে।’
মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতজ্ঞ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল গত মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর আফতাবনগরের নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
প্রখ্যাত এই সংগীত পরিচালক ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭০ দশকের শেষলগ্ন থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সংগীতশিল্পে সক্রিয় ছিলেন।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলী বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। অসংখ্য চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।
তাঁর সুরের উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘সেই রেললাইনের ধারে’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারণ্য লাবণ্য’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘আম্মাজান আম্মাজান’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘এই বুকে বইছে যমুনা’ ইত্যাদি।