প্রজাশূন্য সম্রাটের দরবার!
সব সময় শতাধিক নেতাকর্মী নিয়ে চলাফেরা করতেন তিনি। তাঁর কার্যালয়ে থাকত হাজারো নেতাকর্মীর ভিড়। সেই কার্যালয় এখন খাঁ খাঁ করছে। এ যেন মন্ত্রী-প্রজাশূন্য এক সম্রাটের দরবার।
বলছিলাম ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি আলহাজ মো. ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের রাজধানী কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনের কথা। সম্রাটকে আটকের গুঞ্জনের পর থেকেই প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে ওই ম্যানশন। এটি যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা সম্রাটের কার্যালয় নামে পরিচিত।
ঢাকায় অবৈধ জুয়া আর ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান শুরুর পর ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে সম্রাট হাজার হাজার নেতাকর্মী নিয়ে ওই কার্যালয়ে উপস্থিত হন। সেই রাত থেকে নেতাকর্মীরা পাহাড়া দিয়ে রাখেন তাদের সম্রাটকে। কিন্তু কয়েকদিন পর জানা যায়, সম্রাট তাঁর কার্যালয়ে নেই। তবু শত শত নেতাকর্মী ওই কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। কয়েক দিনের ব্যবধানে ওই কার্যালয়কে ঘিরে কৌতূহল কমে আসে নেতাকর্মীদের। কমে যায় পদচারণা। গতকাল শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বক্তব্যের পর প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে এ কার্যালয়! এক সময়ের হাজার হাজার নেতাকর্মীদের ভিড়, জৌলুস ও ক্ষমতার দাপট এখন অনেকটাই মলিন।
আজ রোববার কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানশনের ফটকের সামনে গিয়ে দেখা যায়, এখানে আগের মতো নেতাকর্মীদের ভিড় নেই। অনেকটা শুনশান নীরবতা। দুই-একজন কর্মী এলেও কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। এসে উঁকি দিয়ে আবার চলে যাচ্ছেন। শুধু গেটে তালা লাগিয়ে দুজন দারোয়ান বসে আছেন। তাঁরা জানান, ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট কয়েকদিন আগে এসেছিলেন। তাঁর মা অসুস্থ। এ জন্য মাকে নিয়ে হাসপাতালে ব্যস্ত রয়েছেন।
কোন হাসপাতালে আছেন, তা জিজ্ঞেস করলেও হাসপাতালের নাম বলতে পারেননি দুই দারোয়ান।
এদিকে ভূঁইয়া ম্যানশনের কার্যালয় ছাড়ার পর থেকে যুবলীগ নেতা সম্রাটকে নিয়ে নানা গুজবের ডালপালাও ছড়াচ্ছে। কেউ বলেন, তিনি আটক হয়েছেন। কেউ বলেন, তিনি নীরবে দেশ ছেড়েছেন। আবার কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে অজানা আশঙ্কার কথাও বলেছেন।
সম্রাটের কার্যালয়ে সামনে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুবলীগের এক কর্মী এনটিভি অনলাইনকে জানান, ‘সম্রাট শেখ হাসিনার পরীক্ষিত কর্মী। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি শিগগিরই কার্যালয়ে ফিরে আসবেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা আর আপনাদের কী বলব? আমাদের পুরো রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে।’
কী হয়েছে জানতে চাইলে ওই সম্পাদক কোনো মন্তব্য করতে চাননি। সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে সম্রাট ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এরপর আর যোগাযোগ করতে পারিনি।’
এর আগে গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘তাঁর (সম্রাট) সম্পর্কে আপনারা অনেক কথা বলছেন। আর আমরা বলছি, সে সম্রাট হোক আর যেই হোক, অপরাধ করলে তাঁকে আমরা আইনের আওতায় নেব।’
গত ১৪ সেপ্টেম্বর শনিবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুবলীগ নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষোভ প্রকাশের পর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা ‘শোভন-রাব্বানীর চেয়েও খারাপ’ বলে মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুবলীগের ঢাকা মহানগরের একজন নেতা যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, চাঁদাবাজি করছে। আরেকজন এখন দিনের বেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে চলেন। সদলবলে অস্ত্র নিয়ে ঘোরেন। এসব বন্ধ করতে হবে। যারা অস্ত্রবাজি করেন, যারা ক্যাডার পোষেন, তারা সাবধান হয়ে যান, এসব বন্ধ করুন। তা না হলে, যেভাবে জঙ্গি দমন করা হয়েছে, একইভাবে তাদেরকেও দমন করা হবে।
যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে ইঙ্গিত করেই প্রধানমন্ত্রী ওই কথা বলেছিলেন বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরই নড়েচড়ে বসেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুবলীগ নেতা খালিদ মাহমুদের ক্যাসিনো ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে বিপুল টাকা ও মাদক উদ্ধার করে র্যাব। ওই দিনই খালিদকে তাঁর গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর পরের দিন ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত দুই নেতাসহ ২৩ সদস্যের একটি দল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। সমাজের সব অসঙ্গতি দূর করব। অপরাধ, অনাচার রোধে যা যা করার করা হবে। যাকে যাকে ধরা দরকার, তাদের ধরা হবে। জানি, কাজটা কঠিন, বাধা আসবেই। কিন্তু জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ফেরাতে সরকার তা করবে।’
খালিদকে গ্রেপ্তারের দুদিনের মাথায় ২০ সেপ্টেম্বর যুবলীগের আরেক নেতা ও প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীমের নিকেতনের বাসায় র্যাব অভিযান চালায়। র্যাব প্রথমে শামীমের সাতজন গানম্যানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর ও বিদেশি মদ উদ্ধার করে।
যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের ব্যাপারে অপেক্ষায় থাকার অনুরোধ জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আজ রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মনে হয় এ ব্যাপারে বলার অথোরিটি তাঁর (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, সেটার ওপর বিশ্বাস রাখুন, প্লিজ, ওয়েট অ্যান্ড সি। শিগগিরই জানতে পারবেন।’
এর আগে গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘অপরাধী যত ক্ষমতাশালীই হোক, রেহাই পাবে না। গা-ঢাকা দিয়েও কেউ আত্মরক্ষা করতে পারবে না। আইনের আওতায় তাকে আসতেই হবে।’ ওই দিনই সম্রাট ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ঘোষণা দেয় সরকার।
ক্যাসিনো ব্যবসায় সম্রাট আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা হয়নি। গতকাল পর্যন্ত ক্যাসিনো সংক্রান্ত ১৭টি মামলা করেছে পুলিশ।