বাংলাদেশ থেকে নেপালে নিয়ে অন্য দেশে পাচার!
শুধু নৌপথ নয়, স্থল ও আকাশ পথে নেপাল হয়েও মানব পাচার হচ্ছে। ভোলায় আটক এক ‘আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী’ দলের সদস্য মো. ফারুক জানালেন এ তথ্য। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, শুধু নেপালেই রয়েছে মানব পাচারকারী চক্রের অন্তত এক হাজার ২০০ সক্রিয় সদস্যের একটি সিন্ডিকেট।
পুলিশ জানায়, নেপালভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী দলের সক্রিয় সদস্য মো. ফারুক। ১৮ মে ভোররাতে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর শশীভূষণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে আঞ্জুরহাটের উত্তর চরমঙ্গল গ্রাম থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফারুক জানান, দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী দলের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন তিনি। ভারত হয়ে নেপাল নেওয়ার পর কাগজপত্র তৈরি করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। তিনি বলেন, ‘আমি এখান থেকে মনে করেন যে নেপালে নিয়া যাই। নেপালে নিয়া যাওয়ার পর ওখান থেকে কাগজপত্র বানাইয়া ওখান থেকে পাঠাইছি বিগত দুই বছর ধইরা। টাকা (নিই) আমি এখান থেইকা, ওদের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল চার লাখ টাকা কইরা।’
কীভাবে এসব লোক পাঠানো হচ্ছে -এ বিষয়ে ফারুক বলেন, ‘এখান থেকে তাদের বাই রোডে নিয়ে যাই, ইন্ডিয়ার পথে বাই রোডে নিয়ে যাই। ওখানে গিয়ে কাগজপত্র করার পর ওরা আমার সাথেই থাকত আমার সাথেই খেত। এখান থেকে ওখানে সৌদি আরবে ওদের পৌঁছানো পর্যন্ত ওরা আমাকে তিন লাখ ৬৫ হাজার করে দিত। এখন পর্যন্ত আমি যে এরিয়াতে থাকি, ওই এরিয়াতে প্রায় এক হাজার থেকে ১২০০ বাঙালি আছে। ওখানে সব দালাল।’
শশীভূষণ থানার ওসি মো. শামসুল আরেফিন বলেন, “ফারুক হোসেন আড়াই থেকে তিন বছর লোক পাচারের নামে নেপালে অবস্থান করে এবং সেখানে নাকি বিবাহ করে সে থাকতেছে। এ দেশ থেকে বিভিন্ন লোক পাচারের জন্য সে ওখানে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে। এখান থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থাৎ সৌদি আরবে লোক পাঠানোর কথা বলে পাঠায় ইন্দোনেশিয়া মালয়েশিয়া, এ সব দেশে পাঠাবার চেষ্টা করে। এসব লোক গিয়ে নানা রকম ভোগান্তির শিকার হয়, এটা সে অকপটে স্বীকার করে যে, ‘আমরা আসলে এ কাজগুলো করি।’ এ ঘটনার সঙ্গে আরো কিছু লোকজন আছে এটা সে স্বীকার করেছে।”
ওসি আরো বলেন, ‘ফারুক আসলে নেপালের কড়াকড়ির জন্য বাংলাদেশে আসে আত্মগোপনে থাকার জন্য। যাদের কাছ থেকে সে টাকা-পয়সা নিয়েছে তারা জানতে পেরে আমাদের জানায়। আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে শনাক্ত করি যে এই সেই ফারুক এবং আমরা তাকে আমাদের কাস্টরিতে নিয়ে আসি।’ এ সময় তিনি কোনো চক্রের সঙ্গ জড়িত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ফরুক আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য বলে আমরা প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছি।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘সে নেপালে থাকে এবং সে প্রায়ই বাংলাদেশে আসে। এখান থেকে আমাদের মানুষজনকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ভাবে সে বিদেশে নিয়ে যায়। মো. ফারুক আন্তার্জাতিক মানবপাচারকারী দলের সদস্য। বিষয়টিকে আমরা কঠোরভাবে দেখতে চাই।’
এ অঞ্চলে স্বামী হারা স্ত্রী আর বাবা হারা সন্তানের মুখ দেখলেই সহজেই বোঝা যায় কতটা কস্টে আছে এসব পরিবার। খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে জীবন কাটছে এসব পরিবারের সদস্যদের। জমি আর মায়ের গলার স্বর্ণ বিক্রি করে দালালের চাহিদা অনুযায়ী ছয় থেকে আট লাখ করে টাকা তুলে দিয়েছেন বিদেশে যাওয়ার আশায়। কিন্তু দেওয়া হয়নি পাসপোর্ট আর ভিসা। স্থল আর বিমান পথে অবৈধভাবে ভারত হয়ে নেপাল তার পরে সেখানের নাগরিক দেখিয়ে অবৈধ কাগজ তৈরি করে পাঠানো হয় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। এসব লোকদের যেখানে নেওয়ার কথা সেখানে না নিয়ে অন্য দেশে নেওয়া হচ্ছে। দুঃখ আর কষ্টের যেন শেষ নেই তাদের। টাকা পাঠানো দূরে থাক উল্টো টাকা পাঠাতে হয় দেশ থেকে।
তার পরও একটি দাবি, মানবপাচারকারী ধরা পড়েছে। এখন যেন তাদের স্বামী, ভাই, আর সন্তান নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসে আর ফেরত পান দালালের নেওয়া সেই টাকা। শাস্তি যেন কম না হয় মানবপাচারকারীর।
ভুক্তভোগী শাহবুদ্দিনের ছোট ভাই মহিউদ্দিন করেন, ‘ফারুকের আব্বাসহ আমার আব্বার মাধ্যমে আট লাখ টাকা নিছে সিঙ্গাপুর নেওয়ার কথা বলে। কিন্তু নিয়েছে সৌদি।’
কথা হয় আরেক ভুক্তভোগীর সঙ্গে। আব্দুর রব নামে ওই ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাকে বিদেশ গিয়ে লাখ লাখ টাকা কামানোর প্রলোভন দেখালে জমি বিক্রি করে তাকে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা দেওয়া হয়। ও আমাকে মালয়েশিয়ার নাম করে বিদেশে নেওয়ার কথা বলে। কিছু দিন পর সে বলে, তোর মালয়েশিয়া ভালো হবে না, তুই লিবিয়া চলে আস। লিবিয়ার কথা বলে সে আমার কাছ থেকে আরো দুই লাখ টাকা নেয়। সে বাংলাদেশ থেকে লোক পাচার করে নেপাল নেয়, নেপালের বাসিন্দা করে সরকারকে ধোকাবাজি করে নেপাল থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাচার করে।’